ডেভিল বধ হোক ইভিলমুক্ত

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৮:২৪ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছোট শয়তান-বড় শয়তান, বাছবিচার করা হবে না, যারা শয়তানী করবে, তারাই অপারেশন ডেভিল হান্টের জালে ধরা পড়বে; প্রকাশ্যে বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরের ডেভিল সদস্যদেরও ছাড় নেই, উল্লেখ করে জানিয়েছেন, অপারেশনের প্রথম দিনই পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শয়তার ধরা মানে ডেভিল হান্ট অভিযানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনও বেশ আশাবাদী। বাজার সিন্ডিকেট সরকারের চেয়ে ক্ষমতাধর নয়, মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে অপারেশন ডেভিল হান্ট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণেও কাজ করবে।

বাজারে চলমান অস্থিরতা এক সপ্তাহের মধ্যে কমে আসবে বলে আশা বাণিজ্য উপদেষ্টার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনও বেশ আশা দেখছেন শয়তান বধ অ্যাকশনে। তিনি বলেন, দুর্নীতির অনেক আসামি বিদেশে। বড় অভিযুক্ত অনেকে পাশের দেশে আছে। তাদের ফিরিয়ে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। অপারেশন ডেভিল হান্ট থেকে দুদক সুফল পেতে পারে বলে অপেক্ষায় তিনি। গোপনে বা কোথাও ক্লোজ ডোরে নয়, রাজশাহী-খুলনা ও মুন্সিগঞ্জে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় কথাগুলো বলেন তারা।

সারাদেশে শনিবার থেকে শুরু হওয়া এ ডেভিল পাকড়াও অভিযানে সামনে ধরা পড়ছে মার্কা মারা ক্রিমিনালরা। সংখ্যায় তা গাজীপুরে বেশি। পরিচয়ে বেশিরভাগই বিগত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ঘরানার। এটাই অনিবার্যতা। গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় এ দলটির ডেভিল সদস্যদের উৎপাতের প্রেক্ষিতেই অভিযানটির সূচনা বা উৎপত্তি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শুক্রবার রাতে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলের বাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে খবর দিয়ে তাদের সেখানে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পিটুনি আহত করা হয়।

এ ঘটনার পর গাজীপুরে বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাদের বিক্ষোভের মুখে দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার। বিক্ষোভ শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে এক শিক্ষার্থী আহত হন। গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে দেশের আরও কয়েক জায়গায় কাছাকাছি ধরনের ঘটনা রয়েছে। যার জেরে সরকারি এ ডেভিল দমন পদক্ষেপ। এর আগে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণা কেন্দ্র করে ৫ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলটির গডফাদার চিহ্নিত নেতাদের বাড়িতে হামলা চলে। এর জেরে অপারেশন ডিভেল হান্ট।

এ ধরনের অপারেশন আরও আগেই নেওয়া দরকার ছিল। দেরি করলে বা সময়ের কাজ সময়ে না করলে যা হয় এখন তা-ই হচ্ছে। এমন অপারেশন দিয়ে সরকারের কার্যক্রম শুরু হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। জল এতো ঘোলা হতো না। এখন প্রশ্ন এসেছে ‘ডেভিল হান্ট’ কোন তালিকা অনুযায়ী চলছে? মাফিয়াচক্র ক্ষমতাকালে কয়েক লাখ সন্ত্রাসের মামলা দিয়ে গেছে সাধারণ বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে। শেখ হাসিনা পালানোর পর কিছু কিছু জায়গায় বিএনপি নেতারা মামলা দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ অন্যদের নামে। সেখানেও আওয়ামী অপরাধীর চেয়ে সাধারণ মানুষের সংখ্যা বেশি। আওয়ামী ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মামলা নেই বললেই চলে। প্রশ্ন হলো প্রকৃত ক্রিমিনাল যারা, ছাত্রজনতা হত্যাকারী-হত্যার সহযোগীদের তালিকা কী যৌথবাহিনীর হাতে আছে? করা হয়েছে এমন তালিকা? বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।

না বললেই নয়, ৫ আগস্টের পর লুণ্ঠিত মালামাল এখনো উদ্ধার হয়নি। পাকড়াও করা যায়নি জেল পলাতকদের। টাটকা এসব অপরাধে জড়িত ডেভিলদের না ধরলে, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হলে অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সেইসাথে টানা ১৫-১৬ বছরের নানা অপকর্মের হোতাদের কেবল দমন নয়, মূলোৎপাটন দরকার। বাংলাদেশ এর আগে নানা নামের অনেক অভিযানের সাথে পরিচিত। অপারেশন থান্ডারবোল্ট, অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭, অপারেশন স্টর্ম ২৬সহ কতো কী? ঘটনার গতিপ্রকৃতি, সময় ও ঘটনাস্থলের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে অভিযানের নাম দেওয়া হয়। এ ছাড়া নামকরণের জন্য শব্দ বাছাইয়ে অভিযানের অনেক কলাকৌশলও থাকে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ড’। ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গিরা হামলা চালালেও পুলিশের অভিযানের কোনো নাম দেওয়া হয়নি। এরপর ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়িতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের জঙ্গি অভিযানের নামকরণ হয় ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’। এক মাস না যেতে ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় আরেকটি অভিযান চালায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযানটির নাম ছিল ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ ’। গাজীপুরের পাতারটেকের একটি বাড়িতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন স্পেইট এইট’।

তবে আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলে র‍্যাবের অভিযান দুটির নাম ছিল না। ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন রিপল ২৪’। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি বাড়িতে চালানো অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬’ । সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে নামকরণ হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন হিটব্যাক’। মৌলভীবাজারের বড়হাট ও কুমিল্লার কোটবাড়িতে চালানো অভিযানের নাম ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ ও ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’।আগের এসব অভিযান নিয়ে ওই সময় নানান কথা বলা হলেও সময়ের ব্যবধানে পরে ভিন্নতথ্য বেরিয়ে এসেছে। সাজানো নাটক ও রাজনৈতিক বাজে উদ্দেশ্যের কথাও অপ্রকাশিত থাকেনি। অভিযানের নামকরণটা আসলে ‘কোড নেম’। তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালিত অভিযানের ক্ষেত্রে এই কোড নেম ব্যবহৃত হয়। তবে যে অভিযানগুলো বড় এবং সুদূরপ্রসারী, সে সবের নামকরণের ক্ষেত্রে অনেক পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়।

এবারের নামকরন অনেকটাই সাদামাটা। যে কারো পক্ষেই এটির অর্থ অত্যন্ত বোধগম্য। উদ্দেশ্যও পরিস্কার। তারওপর এবার গোপনীয়তা বা নাটকীয়তার কিছু নেই। কোনো ইভিল বা অস্বচ্ছতা যেন না থাকে ডেভিল বধে। ডেভিল আর ইভিল শুনতে কাছাকাছি। অর্থও কাছাকাছি। শয়তান আর অশুভ। এখানে রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে নেই। এ সরকার অরাজনৈতিক। কিন্তু, আগামীদিনের রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক দায়িত্ব এ সরকারের ওপর। অভিযানে লুটকারী, গনহত্যাকারী, অর্থ পাচারকারীদের বিচার হবে না সত্য। তবে মাঠ দাবড়ানো সন্ত্রাসী, মাদকের কারবারি, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্তদের পাকড়ানোর মাধ্যমে বিচারের একটি বাতারবরণ তথা নমুনা কিন্তু মিলবে। তেমন কিছুই দেখতে চায় মানুষ। রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অরাজনৈতিক সরকারের এ কাজটিতে দ্রুত সফল হওয়ার আশা বেশি থাকে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিন্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।