নতুন বন্দোবস্ত তরুণ সমাজ এবং আগামীর বাংলাদেশ

সম্প্রতি আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘রাজনীতিতে তরুণদের আরও সক্রিয় হতে হবে’। তার বক্তব্যটি তরুণ প্রজন্মের কাছে নিছক মতামত হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বরং একটি দিকনির্দেশনা হিসেবেই গ্রহণ করা শ্রেয়। তাঁর এই বক্তব্য আমাদের জাতীয় চেতনায় একটি জরুরি আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আজকের তরুণ সমাজ আগামীর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নায়ক। শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানেরও তারা অগ্রনায়ক। যে কারণে রাজনীতির প্রতিটি পরতে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্ব দিন দিন আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ৩৬ জুলাই তাদের কাছে এই শপথের অঙ্গীকার। যে কারণে তরুণদের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হওয়া এখন কেবল প্রয়োজন নয়, অনিবার্য বাস্তবতাও। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পর্যন্ত-তরুণরাই ছিলেন সামনে। ১৯৫২-র শহীদ সালাম, রফিক, বরকত ছিলেন তরুণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনানী ছিলেন তরুণরা। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতাই ছিল নেতৃত্বে। শাহবাগ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন-সবখানেই তরুণরাই দিয়েছে নেতৃত্ব, দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত। তরুণরা কেবল প্রতিবাদের মাধ্যমে ক্ষোভই প্রকাশ করেনি, যুক্তি ও গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
সেই লক্ষ্যেই সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। নবগঠিত এই রাজনৈতিক সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের পর তারা মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ ও নতুন বন্দোবস্তের লক্ষ্যে তারুণ্যের প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। যার মূল লক্ষ্য আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ। তাদের বিশ্বাস, ইতিহাসের প্রতিটি মৌলিক পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণেরা। এখন সময় এসেছে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও নতুন প্রজাতন্ত্র নির্মাণের।আমি এই সংগঠনটির গর্বিত কর্মী। আমরা চাই দায় ও দায়িত্ব বোধের রাজনীতি। তারা মনে করে রাজনীতির নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব গ্রহণ, সহানুভূতিশীলতা, সহনশীলতা এবং নাগরিকের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ। দায়িত্ব, সহানুভূতি ও মানবিকতা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দায় ও দায়িত্ব বোধের রাজনীতিই অধিকার ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাই এই আদর্শের রাজনীতির অনুশীলন হোক আমাদের অন্যতম নৈতিক ভিত্তি।
আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে নাগরিক মর্যাদা কাগজে নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হবে। যেখানে রাষ্ট্র সব ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিসত্তার মর্যাদা দেবে। যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কেবল স্লোগান নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি হবে। যেকোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ ও উগ্রতাকে পরিহার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবোধ ও সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সম্প্রীতি, ইনসাফ ও নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে।
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ কেবল একটি রাষ্ট্রিক সীমানা নয়। এটি একটি ব-দ্বীপীয় সভ্যতা। এ সভ্যতা আমাদের ভূগোলনির্ভর, বহু ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক এক ঐতিহাসিক সত্তা, যা পাহাড় থেকে নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চলজুড়ে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব নিতে হবে বাংলাদেশকে। সেই নেতৃত্বকে নিতে হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সভ্যতাগত রূপান্তর প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন পথ দেখাবে বাংলাদেশ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ফ্যাসিস্ট জমানায় মূলধারার রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমে গিয়েছিল। অনেক তরুণই রাজনীতিকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অসৎ বলেই ভাবতে শিখেছে। এর ফলে দেশের মেধাবী একটি অংশ রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা রেখে বলতে হয়, তরুণদের রাজনীতিতে ফেরানোর জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোটাভিত্তিক নেতৃত্বের স্থান নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ড, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে কমপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশ পদ তরুণদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সুষ্ঠু এবং কার্যকর নেতৃত্বের জন্য তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
দ্বিতীয়ত, তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘নাগরিক শিক্ষা’ এবং ‘নৈতিক নেতৃত্ব’ বিষয়ক পাঠ্যক্রম বাধ্যতামূলক করা দরকার। এতে তরুণরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী এবং সচেতন হয়ে উঠবে। এই শিক্ষা তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, যা ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তৃতীয়ত, তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সক্ষমতা রাজনৈতিক দলে কাজে লাগাতে হলে একটি সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। আজকের তরুণরা সংঘাতমুখী নয়। তারা সহমত ও সমঝোতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু রাজনীতি এখনো অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত, অপবাদ, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধে ভরপুর। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে তরুণরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে হতাশ হয়ে পড়বে।
চতুর্থত, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার তরুণদের উৎসাহিত করতে পারে। তরুণদের সফল নেতৃত্বের গল্প প্রচার, রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনকারী তরুণ জনপ্রতিনিধিদের কাজ তুলে ধরা তরুণদের অনুপ্রাণিত করবে। পাশাপাশি নেতিবাচক রাজনীতির প্রতি তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।
বহির্বিশ্বে তরুণ নেতৃত্ব কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষানীতি, নারী অধিকারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। আজকের পৃথিবী, যেখানে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ, সংকট এবং সমস্যার মুখোমুখি, সেখানে তরুণরা তাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং সাহসিকতার মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল, তরুণ জনগোষ্ঠীসমৃদ্ধ দেশে এই ধরনের নেতৃত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়।
আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছেন, যারা আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। এই তরুণরা যদি তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন, তবে তারা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় উন্নতি আনতে সক্ষম হবে। তরুণদের রাজনীতিতে আসার পথ সুগম করতে হলে কেবল আহ্বান নয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার বিশ্বাস, রাজনীতিতে তরুণরা যদি নেতৃত্ব দেয়, তাহলে সেই রাজনীতি হবে গণমুখী, মানবিক এবং অগ্রগতিমুখী। কারণ তরুণরা স্বপ্ন দেখে, সাহস করে, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের সবটুকু ঢেলে দেয়। তাদের এই শক্তিকে অবজ্ঞা নয়, স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশ গড়ার রাজনীতিতে তাদের অগ্রণী ভূমিকাই হোক আগামী বাংলাদেশের প্রধান দিকনির্দেশনা।
লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এইচআর/এএসএম