অভিবাসনবিরোধী ডানপন্থা এবং নাইজেল ফারাজ

ফারুক যোশী
ফারুক যোশী ফারুক যোশী , প্রবাসী সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৪৩ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ব্রিটেন—যে দেশটি বহুকাল ধরে বহুজাতিক, বহু-সংস্কৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন হিসেবে পরিচিত—আজ অভিবাসনবিরোধী উগ্রতার এক নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি। সাম্প্রতিক অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ, যেখানে ডানপন্থি গোষ্ঠীর সরব উপস্থিতি ছিল, আমাদের মনে করিয়ে দেয়: ইতিহাসের চাকা ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়, যখন সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ে।

২) ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে BNP (British National Party), EDL (English Defence League)-এর মতো চরম ডানপন্থি সংগঠনগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যদিও এদের সাংগঠনিক ভিত্তি একদম নড়বড়ে। ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের সময় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য ও প্রচারণা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসেবে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল।

লন্ডনের রাজপথে অভিবাসনবিরোধী স্লোগান, বিদ্বেষমূলক সমাবেশ—এসব যেন ব্রিটেনের বহুত্ববাদী চেতনায় আঘাত হানে। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে প্রায় ১০,০০০ মানুষ অংশ নেয়, যেখানে ডানপন্থি গোষ্ঠীর পাশাপাশি কিছু ফুটবল হুলিগানও যুক্ত হয়। পুলিশের তথ্য মতে, এ ধরনের সমাবেশে সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে (সূত্র: মেট্রোপলিটন পুলিশ রিপোর্ট, ২০২৩)।

৩) এখানে নাইজেল ফারাজের মতো নেতাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি ব্রিটিশ রাজনীতির এক বিতর্কিত নাম। ইউকিপ (UKIP) এবং পরবর্তীতে ব্রেক্সিট পার্টির নেতা হিসেবে তিনি অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিকে মূলধারায় নিয়ে আসেন।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সম্পদ, ও রাজনৈতিক অবস্থান—সবকিছুই যেন ব্রিটেনের ডানপন্থি রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। মিডিয়ায় নিজের ধ্যান-ধারণার সুড়সুড়ি বিক্রি করে হাজারো-লাখো পাউন্ড কামাই করে উপরোল্লিখিত কিছু সুবিধা বঞ্চিত এবং কিছু একদম উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুখপাত্র সাজার চেষ্টা করেন, অথচ নিজেকে শ্রমজীবী মানুষের বন্ধু বলে দাবি করেন।

তাঁর রাজনৈতিক কৌশল—সমাজের প্রকৃত সংকট (অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকট) থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অভিবাসীদের ‘অপরাধী’ বানানো। তাঁর ভাষায়, অভিবাসীরা নাকি ব্রিটেনের কল্যাণব্যবস্থাকে ‘দেউলিয়া’ করে দিচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো, অভিবাসীরাই এই ব্যবস্থার চালিকাশক্তি।

নাইজেল নিজেকে “জনগণের বন্ধু” হিসেবে উপস্থাপন করলেও, বাস্তবে তিনি পুঁজিবাদী অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি। তাঁর লাখ লাখ পাউন্ডের সম্পদ, এবং মিডিয়া ও রাজনীতিতে প্রভাব—সবই তাঁকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়।

আশার কথা, ব্রিটেনের সমাজে এখনও মানবিকতা ও সংহতির শক্তি প্রবল। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, বর্তমান উগ্রদের আস্ফালনে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রতিবাদ—এসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বৈচিত্র্যই ব্রিটেনের আসল শক্তি। ২০২০ সালের জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটেনে ২৬০টিরও বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে, যেখানে অভিবাসী ও স্থানীয়রা একসঙ্গে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন।

তবুও, তিনি অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যকে হাতিয়ার বানিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান। তাঁর ভাষায়, অভিবাসীরা ব্রিটেনের কল্যাণব্যবস্থাকে “দেউলিয়া” করে দিচ্ছে—এমন এক বিভ্রান্তিকর প্রচার, যার বাস্তবতা নেই।

৪) কিছু ডানপন্থি গণমাধ্যম নাইজেল ফারাজসহ এরকম উগ্র রাজনীতিবিদদের ইন্ধন দিয়ে থাকে তাদের বিভিন্ন রকম প্রচার প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। ইদানীং হোম সেক্রেটারি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিদেশে অপরাধীদের জাতীয়তা প্রকাশ করা হবে। এই ধরনের তথ্য রিলিজ করার উদ্দেশ্য হিসেবে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে যে, বিদেশিদের অপরাধের সংখ্যার প্রকৃতি জনগণের জানার “অধিকার” আছে, তবে সমালোচকরা বলছেন এটা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা বাড়াবে এবং “foreign criminals”(বিদেশী অপরাধী) এই ট্যাগ দিয়ে জনমতকে এন্টি-ইমিগ্রেন্ট মূখি করতে প্রভাবিত করা হবে।

'দি সান' ট্যাবলয়েড এতে এগিয়ে থাকে সবসময়ই। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সান শিরোনাম করেছে ব্রিটিশ করদাতাদের অর্থে পরিচালিত হোটেলগুলোতে বসবাসরত শত শত আশ্রয়প্রার্থীকে আদালতে হাজির করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ডাকাতি এবং গুরুতর শারীরিক আঘাতসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, অথচ ব্রিটেনে শত শত শহরে আদালত আছে এবং এগুলোতে হাজিরা দেয়া সংখ্যাগরিষ্ঠরাই হলো ব্রিটিশ নাগরিক এবং সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীও তারাই।

এসব শিরোনামগুলো স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেনের শিক্ষা-দীক্ষায় অনীহা থাকা পেছনে পড়ে থাকা কিছু নিম্নবিত্ত এবং কতিপয় উচ্চবিত্ত ব্রিটিশদের গছিপের বিষয় হয়ে যায়। নাইজেল ফারাজরা তা নিয়েই ব্যবসা করেন রাজনীতির।

৫) Runnymede Trust-এর একটি রিপোর্ট বলেছে যে রাজনীতিবিদ ও মিডিয়ায় অভিবাসীদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুক্ত শব্দগুলোর মধ্যে “illegal” (অবৈধ) অন্যতম। এই ধরনের ভাষা সাধারণভাবে অভিবাসীদের ''আইনবহির্ভূত'', ''অবৈধ'' ইত্যাদি রূপে চিত্রিত করে, যা তাদেরকে একটি নেগেটিভ ক্যাটাগরিতে স্থান দেয়।

মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীসহ দক্ষিণ এশীয়রা প্রায়ই এইসব নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হন। অথচ, NHS-এ (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) অভিবাসী চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক কর্মীরাই ব্রিটেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন। একটি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে NHS-এ কর্মরত চিকিৎসকদের প্রায় ২৮% এবং নার্সদের ১৫% অভিবাসী পটভূমি থেকে এসেছেন (সূত্র: NHS Digital)। কৃষিক্ষেত্রে, নির্মাণে, পরিষেবায়—অভিবাসীদের শ্রম ছাড়া ব্রিটেনের অর্থনীতি অচল। প্রশ্ন জাগে—NHS-এ অভিবাসী চিকিৎসক, নার্স, কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিক, কিংবা বৃদ্ধদের সেবায় নিয়োজিত থাকা এমনকি খাদ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসাতে অভিবাসীদের অবদান কি নাইজেল কিংবা তাঁর সমর্থকরা অস্বীকার করতে পারেন?

৬) ব্রিটিশ সরকার অভিবাসন নীতিতে কঠোরতা আরোপ করেছে—ভিসা, নাগরিকত্ব, সামাজিক সেবা—সবখানেই জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা। এতে অভিবাসীরা নিজেদের অরক্ষিত, অবহেলিত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দেখছেন।

২০২৩ সালে সরকার নতুন আইন পাস করেছে, যেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য হোম অফিসের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার সময়কাল আরও দীর্ঘ করা হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাজ করার সুযোগও সীমিত করা হয়েছে (সূত্র: Home Office Annual Report, 2023)। এমনকি, নাইজেলের সাম্প্রতিক প্রস্তাব—‘ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন’ বাতিল, স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ সুবিধা কেবল বীমা-নির্ভর করা—এটি এক ধরনের মার্কিন মডেল অনুসরণ করার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা আরও বেশি বঞ্চিত হবেন।

তবে আশার কথা, ব্রিটেনের সমাজে এখনও মানবিকতা ও সংহতির শক্তি প্রবল। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, বর্তমান উগ্রদের আস্ফালনে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রতিবাদ—এসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বৈচিত্র্যই ব্রিটেনের আসল শক্তি। ২০২০ সালের জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটেনে ২৬০টিরও বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে, যেখানে অভিবাসী ও স্থানীয়রা একসঙ্গে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন।

সুতরাং চাইলেই নাইজেল ফারাজ কিংবা তাঁর দল ক্ষমতায় আসার কোনো সুযোগ পাবেন না, যদিও শুধু ব্রিটিশ রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থা জিইয়ে রাখতে তিনি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবেন হয়তো।

লেখক : বৃটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।