আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

উন্নয়ন ও মানবিক মূল্যবোধ: বাংলাদেশ কোন পথে?

ড. রাধেশ্যাম সরকার
ড. রাধেশ্যাম সরকার ড. রাধেশ্যাম সরকার , লেখক: কৃষিবিদ, গবেষক।
প্রকাশিত: ১১:৫২ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, এমন এক সময় যেখানে উন্নয়নের পরিমাপের কাগজ খুললে আলো ঝলমল করে ওঠে, কিন্তু সমাজের ভেতরের মানবিক সংকট দেখলে সেই আলো মুহূর্তেই ম্লান হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার অর্ধশতক পার করে দেশ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থানের পথে হাঁটছে ঠিকই, তবু সেই উত্থানের সঙ্গে নৈতিকতার ভিত সমানভাবে শক্ত হয়েছে কি না এই প্রশ্ন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে।

অর্থনীতির পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। পোশাকশিল্পের রপ্তানি অর্জন, বিদেশে কর্মরত মানুষের রেমিট্যান্স প্রবাহ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, সেতু থেকে হাইওয়ে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত অবকাঠামোর দৃশ্যমান অগ্রগতি, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিদ্যুতায়ন, নারীর শ্রমবাজারে প্রবেশ, ডিজিটাল সেবার বিস্তার সব মিলিয়ে উন্নয়নের গতি সত্যিই প্রশংসনীয়। একসময়ে যে গ্রামে অন্ধকার নামে সকাল সন্ধ্যায়, আজ সেখানে আলো জ্বলে, ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে, আর নগরমুখী সুবিধাও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই পটভূমি নিঃসন্দেহে আশার দিগন্ত খুলে দেয়।

কিন্তু এই আলোর পাশেই জেগে আছে এক ভিন্ন অন্ধকার বাস্তবতা, যেখানে সমাজের নৈতিক ভিত্তি ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব, বৈষম্য, অনিয়ম, অমানবিক প্রতিযোগিতা, সহিংসতার বিস্তার সবকিছুই উন্নয়নের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা কঠিন সত্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা সংকুচিত হয়ে আসছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মানবিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে, ফলাফলকেন্দ্রিক পাঠদানের চাপ এবং প্রতিযোগিতার নাম করে তৈরি মানসিক চাপ মানুষের ভেতরের মূল্যবোধের জায়গাটিকে ক্রমে সংকুচিত করে তুলছে। এক প্রজন্ম বড় হচ্ছে সাফল্যের মানদণ্ডকে অর্থ দিয়ে মাপতে শিখে, মানবিকতার গুরুত্ব ভুলে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য এই নৈতিক সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে। সমাজের এক অংশ প্রযুক্তি ও আধুনিকতার উজ্জ্বল চূড়ায় অবস্থান করছে, আর অন্য বিশাল অংশ এখনো মৌলিক জীবনসংগ্রামে আটকে আছে। যখন এই ব্যবধান দৃষ্টিগোচরভাবে বড় হয়ে ওঠে, তখন মানুষের মনে অসন্তোষ, হিংসা, অস্থিরতা ও অপরাধপ্রবণতা দানা বাঁধে। ন্যায়বোধ দুর্বল হয়ে যায়, সমাজের অভ্যন্তরীণ শান্তি ভেঙে পড়তে থাকে।

ডিজিটাল যুগ এসে সংকটকে আরও জটিল রূপ দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে কৃত্রিম সাফল্য দেখানোর প্রতিযোগিতা, জনপ্রিয়তার ছলচাতুরি, গুজব এবং অপপ্রচার মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধকে ক্ষয় করছে। অনলাইন দুনিয়া মানুষকে একদিকে যুক্ত করলেও, অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে সত্য থেকে, সংযম থেকে এবং সহমর্মিতা থেকে। ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর উন্মাদনায় বাস্তব জীবন এবং সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

ন্যায়বিচারের বিলম্ব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি নৈতিকতার আরেক কঠিন শত্রু। অপরাধী যখন শাস্তি পায় না, দুর্নীতি যখন অব্যাহত থাকে এবং নির্দোষ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে, তখন মানুষের বিশ্বাস কাঠামো ভেঙে যায়। যে সমাজে বিশ্বাস ভেঙে পড়ে, সেখানে নৈতিকতা কখনোই স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের যাত্রাপথ তাই এক দ্বৈত চিত্র এঁকে দেয় একদিকে অগ্রগতির উজ্জ্বল রঙ, অন্যদিকে মূল্যবোধের খরা। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেই আসে, আমরা কি সত্যিই এগোচ্ছি, নাকি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হারাচ্ছি মানবিকতার মাটি।
এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক ভিত্তিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শক্ত করতে হবে। দরকার এমন একটি সমন্বিত পথনকশা যেখানে উন্নয়নের মাপকাঠি হবে কেবল সংখ্যা নয়, বরং মানুষের আচরণ, চিন্তাশক্তি, দায়িত্ববোধ এবং চরিত্রের উন্নত মান। উন্নয়নের আসল সাফল্য তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন দেশের অগ্রগতি এবং মানুষের মানবিকতা একই স্রোতে প্রবাহিত হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি কথাটি এখন শুধু নীতি প্রণেতাদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক স্তর থেকেই নৈতিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পেতে হবে, কারণ শিশুর প্রথম শেখা মূল্যবোধই তার পরবর্তী জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। মানবিকতা, সততা, নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং সহমর্মিতার মতো বিষয়গুলোকে কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; বাস্তব উদাহরণ, দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সহজ অনুশীলনের মাধ্যমে এগুলো শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণেও নৈতিক মূল্যবোধকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে শিক্ষকরা নিজেদের আচরণ ও মনোভাব দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সত্যিকারের আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন। পরীক্ষা ও নম্বর নির্ভর প্রতিযোগিতা যে শিক্ষার্থীদের ভেতরের মানবিক অংশটিকে ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত করে ফেলে, সেটি এখন স্পষ্ট। তাই এই প্রতিযোগিতা কমিয়ে চরিত্র গঠনের শিক্ষাকে বিস্তৃত করার প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিক্ষাকে এই মানবিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে মূল্যবোধসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল নাগরিক।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাসন কথাটি শুধু শ্লোগান হয়ে থাকলে কোনো পরিবর্তন আসে না; তাই প্রয়োজন বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ। স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তুলতে ডিজিটাল ফাইল ট্র্যাকিং, অনলাইন বিলিং এবং স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন ব্যবস্থার মতো প্রযুক্তিনির্ভর সেবাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ এগুলো দুর্নীতির সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার সংস্কার, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং পুলিশের জবাবদিহি শক্ত করার মতো পদক্ষেপ একটি নৈতিক সমাজ গঠনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যখন সিস্টেম স্বচ্ছ হয়, আইন দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ হয় এবং প্রশাসন জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে, তখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাসন বাস্তব রূপ পেতে পারে।

পারিবারিক কাঠামো পুনর্গঠন এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন, কারণ পরিবারই মানুষের প্রথম বিদ্যালয় এবং মূল্যবোধ শেখার সূতিকাগার। পরিবারের ভেতরে সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথনের অভ্যাস তৈরি করা, তাদের চোখে আকাশভরা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করা এবং পারিবারিক অনুষ্ঠান ও উৎসবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার মতো ছোট ছোট উদ্যোগই নৈতিকতা গঠনের বড় শক্তি হয়ে ওঠে। পরিবার যখন নিজের ভেতরে উষ্ণতা, দায়িত্ববোধ ও সম্মানের চর্চা ধরে রাখতে পারে, তখনই সন্তানের মনে মানবিকতার প্রথম বীজ অঙ্কুরিত হয়। তাই পারিবারিক পরিবেশকে সজীব, সংযুক্ত ও মূল্যবোধভিত্তিক রাখা একটি সুস্থ সমাজ গঠনের অপরিহার্য ধাপ।

ডিজিটাল নাগরিকত্ব চর্চা এখন আর ঐচ্ছিক নয়, বরং আধুনিক সমাজে সুরক্ষিত ও দায়িত্বশীলভাবে বেড়ে ওঠার অপরিহার্য শর্ত। সামাজিক মাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার শেখানো, ভুয়া তথ্য প্রতিরোধের কৌশল বোঝানো, অনলাইন নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করা এবং ভার্চুয়াল পরিবেশে সম্মানজনক আচরণ গড়ে তোলার জন্য স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ডিজিটাল সিটিজেনশিপ পাঠ চালু করা অত্যন্ত জরুরি। তরুণরা যখন প্রযুক্তির ভেতরেই বড় হচ্ছে, তখন তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারলেই ডিজিটাল দুনিয়ার ঝুঁকি কমে এবং একই সঙ্গে গড়ে ওঠে একটি সচেতন, নৈতিক ও নিরাপদ অনলাইন প্রজন্ম।

বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ আজকের সমাজে স্থিতিশীলতা ও নৈতিকতার ভিত পুনর্গঠনের অন্যতম প্রধান শর্ত, কারণ দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ন্যায্য মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের মতো পদক্ষেপই বৈষম্য কমিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখে। যখন কর্মক্ষম মানুষ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়, তখন তারা স্থায়ী আয়ের পথ খুঁজে নিতে পারে; তেমনি ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত হলে শ্রমের সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শোষণের সুযোগ কমে আসে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ায়, যাদের জীবনে সামান্য সহায়তাই বড় পরিবর্তন আনে। এই সব উদ্যোগ একত্রে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যবধান কমায়, অসন্তোষ ও হিংসা হ্রাস করে এবং নৈতিক ভিত্তিকে শক্ত করে তোলে। বৈষম্য কমলে মানুষ একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং সহযাত্রী হিসেবে দেখতে শেখে, আর তখনই সমাজে ন্যায়, মানবিকতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে উন্নয়নের পরবর্তী অধ্যায় নির্ভর করছে মূল্যবোধের পুনর্গঠনের ওপর। অর্থনীতি যতই সমৃদ্ধ হোক না কেন, যদি সমাজের ভেতরে সততা, ন্যায়বোধ, সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতা দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সেই উন্নয়ন কখনোই স্থায়ী রূপ নেবে না। এত অর্জন, এত অগ্রগতি, এত অবকাঠামোগত সাফল্য সবই তখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ে যখন মানবিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই আমরা যতটা উন্নয়নকে বাহ্যিকভাবে উদযাপন করি, ততটাই জরুরি এর মূলে থাকা নৈতিকতার শেকড়কে আরও গভীরে প্রোথিত করা। উন্নয়ন তখনই সত্যিকারের উন্নয়ন হয়ে ওঠে যখন তা শুধু অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নয় বরং মানুষের মন, আচরণ, চরিত্র ও চিন্তার ভেতর একটি আলোকবর্তিকা জ্বালাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তাই কেবল অবকাঠামো বা প্রবৃদ্ধির সাফল্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এই প্রশ্নে নির্ধারিত হবে যে মানবিক মূল্যবোধ কতটা গভীরভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নৈতিকতার আলো যত বিস্তৃত হবে, ততটাই টেকসই ও শক্তিশালী হবে আমাদের অগ্রগতি; আর সেই আলোই আগামী দিনের প্রকৃত উন্নয়নের দিশা দেখাবে।

লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।