স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার, বাস্তবতা এবং আবেগ

ডা. পলাশ বসু
ডা. পলাশ বসু ডা. পলাশ বসু , চিকিৎসক ও শিক্ষক
প্রকাশিত: ১০:২২ এএম, ১৬ মার্চ ২০১৮

 

কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা কেউই চাই না। স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের ইতি ঘটুক সেটাই আমরা চাই। তবু বেশ কিছু বছর ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। যদিও এর সাথে সামাজিক, আইনগত, ধর্মীয় নানা বিষয় জড়িত রয়েছে। ফলে এ ব্যাপারে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নীরবতাকেই সম্বল করেছে। আবার এর সাথে আবেগীয় বিষয়ও জড়িত রয়েছে বটে।

‘যাদের অর্থের অভাব নেই তারা চাইলে তাদের রোগীটিকে সকল সাপোর্ট দিয়ে রাখতে চায় রাখুক। সেটা নিয়ে তো কারো কোনো কথা নেই। কিন্তু যে পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে আবার রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা একদমই নেই- সেক্ষেত্রে পরিবারটি চাইলে তো রোগীর দেহ থেকে সহায়ক যন্ত্রপাতি খুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতেই পারে। সে অধিকার কি তাদের থাকা উচিত নয়?’

বিজ্ঞাপন

যদিও বিশ্বব্যাপী ৪ টি দেশ স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দিয়েছে। তবে, তারা বলেছে নির্দিষ্ট আইন কানুনের মাধ্যমেই সেটা করতে হবে এবং স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার পেতে হলে তা একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে। স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত ঐ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দলটিই নিবেন। একে বলা হচ্ছে “একটিভ ইউথেনেসিয়া”। বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ এবং নেদারল্যান্ডের একজন রোগী চাইলে নিজের স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করতে পারবে।

তবে, যথাযথ মেডিকেল বোর্ড তখন সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া আছে। রোগী চাইলেই হবে না। আবার ক্রাইটেরিয়াগুলো পূরণ না করলে মেডিকেল বোর্ডও এমন আবেদনে সাড়া দিতে পারবে না। দিলে সেটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। অবশ্য সুইজারল্যান্ডে একে “এসিসটেড সুইসাইড” ( সহায়তা নিয়ে আত্মহনন) নামে স্বীকৃতি দিয়েছে। “এসিসটেড সুইসাইড” অবশ্য আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, অরিগন, ওয়াশিংটন, মন্টানা এবং ভারমন্টে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গত ৯ মার্চ, ২০১৮ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেখানে মুমূর্ষু কিংবা মৃতপ্রায় ব্যক্তির পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে ৫ম দেশ হিসেবে ভারতের নাম তাই অধিভুক্ত হলো। তবে, এটা কিন্তু উপরে বর্ণিত দেশ সমূহের “একটিভ ইউথেনেসিয়া” বা “ এসিসটেড সুইসাইড” নয় । এটা “প্যাসিভ ইউথেনেসিয়া” বা পরোক্ষভাবে মৃত্যু ঘটানো। এটা কেমন তাহলে?

এটা হচ্ছে, এমন কোনো মুমূর্ষু রোগী যদি থাকে তার আর বাঁচার একদমই সম্ভাবনা নেই এবং কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা মেশিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এমন ক্ষেত্রে যদি রোগীর আত্মীয়স্বজন চায় তাহলে তারা মেডিকেল বোর্ডের কাছে আবেদন করতে পারবে। এবং মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তই তখন চূড়ান্তভাবে বিবেচিত হবে যে সে রোগীর সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি খুলে নেয়া ঠিক হবে কি হবে না!

বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ফলে মানুষের আয়ু বেড়েছে। অবাক হলেও সত্য যে, মৃত্যুকে এখন চাইলে অনেকক্ষেত্রে দেরী করানো সম্ভবপর হচ্ছে। যেমন ধরুন আইসিইউ সাপোর্ট। এ সাপোর্ট যখন ছিলো না তখন রোগীকে একদম অদৃষ্টের উপরে ছেড়ে দেয়া হতো। এসব রোগীর বাঁচা-মরা একদম নিয়তির হাতে সমপির্ত হতো।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেখা যেতো শেষাবধি রোগীর মৃত্যুই ঘটতো। তবে, সে সময়ে রোগীটিকে যদি আইসিইউ সাপোর্ট দেয়া যেতো তাহলে হয়ত তার বাঁচার সম্ভাবনা বাড়তে পারতো। এখন তো এভাবে অনেকে মৃত্যুর ঘর থেকে ফিরে আসছেন। যমে-মানুষে টানাটানি শেষে মানুষটি জয়ী হচ্ছেন। ফলে কত পরিবারের মুখে যে আবার হাসি ফুটছে তার কি ইয়ত্তা আছে?

এবার ধরুন আইসিইউ সাপোর্টে থাকা রোগীটির আর বাঁচার বা ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবুও শুধুমাত্র আবেগের উপর ভর করে এমন রোগী অথবা অশীতিপর বৃদ্ধ একজন মানুষকে দিনের পর দিন লাইফ সাপোর্ট দিতে গিয়ে একটা পরিবার কিভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে সেটা কি একবারও আমরা ভেবে দেখছি? অনেক সময় দেখা যায়, জমিজমা, সহায় সম্পত্তি সবকিছু বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে পরিবারটি পথের ফকির হয়ে যাচ্ছে।

তবে, যাদের অর্থের অভাব নেই তারা চাইলে তাদের রোগীটিকে সকল সাপোর্ট দিয়ে রাখতে চায় রাখুক। সেটা নিয়ে তো কারো কোনো কথা নেই। কিন্তু যে পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে আবার রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা একদমই নেই- সেক্ষেত্রে পরিবারটি চাইলে তো রোগীর দেহ থেকে সহায়ক যন্ত্রপাতি খুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতেই পারে। সে অধিকার কি তাদের থাকা উচিত নয়?

বিজ্ঞাপন

এ তো গেলো লাইফ সাপোর্ট রোগীর কথা। এখন ধরুন প্রচন্ড রকমের শারীরিক ভোগান্তি নিয়ে ( যেমন ক্যান্সার) ধীরে ধীরে একজন মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খাবার খেতে পারে না, শারীরিক যন্ত্রণা, অসহ্য ব্যথা, ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধ আর কাজ করছে না, আজ হোক বা কাল হোক মৃত্যু নিশ্চিত সে ক্ষেত্রে এমন যন্ত্রদায়ক মৃত্যু পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে একজন মানুষ যদি স্বেচ্ছায় তার মৃত্যু চায় সেটা কি অপরাধ হবে?

অনেক সময় আমরা দেখেছি, এমন ধরনের রোগী মারা গেলে অনেকে মন্তব্য করে থাকেন যে, লোকটি অনেক অনেক যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন। বরং মরে গিয়েই উনি বেঁচে গেছেন। যিনি এমন মন্তব্য করলেন তিনি কি খারাপ কিছু বললেন? নাকি লোকটির বেঁচে থাকা সময়ের কঠিনতম যন্ত্রণা দেখেই উনি লোকটির মারা যাবার পরে স্বগতোক্তির মতো করেই এমন মন্তব্য করেছেন? এখন এই যে, এমন রোগীর ক্ষেত্রে আমরা বলছি যাক লোকটা মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন; তাহলে তার মৃত্যু কি আর একটু সহজ হতে পারতো না?

ফলে “স্বেচ্ছামৃত্যু” বা ”ভালোভাবে মৃত্যু” “একটিভ বা প্যাসিভ ইউথেনেসিয়া” যাই বলি না কেন সেটা নিয়ে আমাদের দেশেও আলাপ আলোচনা হওয়া উচিত। সমাজের নানা সেক্টরের মানুষ যেমন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, সুশীল, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, আইনজ্ঞ প্রমুখ ব্যক্তি বা এমন সংগঠন যারা এটা নিয়ে কথা বলছে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করা যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

কিভাবে, কখন এমন মৃত্যুর জন্য আবেদন করা যাবে এবং রোগীর অবস্থা কেমন হলে মেডিকেল বোর্ড তাতে সাড়া দিতে পারবে-সে বিষয়ে একটা গাইডলাইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। তাহলে মনে হয় সবদিক রক্ষা পায়। এটা নিয়ে মনে হয় এখন সত্যি সত্যি জোরালোভাবে ভাবার সময় এসেছে।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।