চীনের ঋণের পরিকল্পিত ভীতি

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৩:৩৬ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চীন সফর করে এসে ৮ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করলে একজন সাংবাদিক তার কাছে চীনের ঋণের ভীতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন এবং চীনের সঙ্গে আমেরিকার যে সম্পর্ক তাতে ঋণ করলে আমেরিকানরা আমাদের ওপর রাগ করে কিনা আশংকা প্রকাশও করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর জবাবের কথা পরে বলছি।

চীন এখন বিশ্বের নতুন মহাজন। ব্রিটিশের মহাজনী শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তারপর শুরু হয় আমেরিকার মহাজনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ইউরোপকে ব্যাপক আর্থিক সহায়তা না করলে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পক্ষে উঠে দাঁড়ানো মুশকিল ছিল। আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হলেও তার আর্থিক জৌলুস ফুরিয়ে গেছে এখন। তার স্থান দখল করেছে চীন।

কবি ইকবালের একটা কবিতা আছে- ‘দো দিন কা চাঁদনী হে, ফের আন্দেরি রাত’। কখন যে কার চাঁদনী রাত আর কখন আন্ধেরি রাত বলা মুশকিল। এখন চীনের চাঁদনী রাত চলছে তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করছে তারা। দুই ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে তার রিজার্ভ। উদারভাবে ঋণ প্রদানের অভ্যাস আছে। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, বাংলাদেশ আর মালদ্বীপ- সবাইকে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু তার ঋণদানের কিছু ফন্দি-ফিকির নাকি রয়েছে, এমন একটা বদনাম রয়েছে বিশ্ববাজারে।

এই রটনাটা ভারত আর আমেরিকাই বলে বেড়াচ্ছে বেশি এবং তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে সুকৌশলে প্রচার করছে। আমেরিকা-ভারত উভয়ের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরের আগেও ভারত আর আমেরিকা কানে কানে বাংলাদেশকে চীনের ঋণ সম্পর্কে সতর্ক করেছে। একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, গরিবের সুন্দরী বউ সবার ভাবী হয়। আমেরিকাকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চীন, ভারতকেও দিয়েছে। তারা যখন ঋণ নেয় তখন কোনো ভয় থাকে না। আমাদের ব্যাপারে সব ভয়। তাদের দরদী উদ্বেগ।

শ্রীলংকার হাম্বানতোতা নামে দক্ষিণের একটা বন্দর চীন ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। হাম্বানতোতা শ্রীলংকার অপর দুটি বড় বন্দর- কলম্বো এবং ত্রিনকোমালির মতো সক্রিয় বন্দর নয়। এখন অনেকটা পরিত্যক্ত। চীন এই বন্দর সংস্কার করে সেখানে নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। চীন শ্রীলঙ্কাকে প্রচুর টাকা ঋণ দিয়েছে। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। শ্রীলংকা ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। তামিলদের সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধে তার উদীয়মান পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন রপ্তানি আয়ে শ্রীলংক চলতে পারে না।

দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় তার বহু বন্দর আছে। শ্রীলংকা তার একটি বন্দর লিজ দিলে সেখানে তার লোকজনের চাকরি হবে। বছর বছর নির্ধারিত অর্থ উপার্জন হবে- এখানে ফন্দিফিকিরের কি আছে? চীন তো ব্রিটিশকে তার হংকং ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। ব্রিটিশরা হংকংয়ের প্রভূত উন্নয়ন করেছে। লিজের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ব্রিটিশরা হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর করে চলে গেছে।

ভারত ভিয়েতনামে নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। আবার মরিশাসে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। সুতরাং চীনেরও ভারতের কাছাকাছি একটি নৌঘাঁটির দরকার। এখন শ্রীলংকার হাম্বানতোতা বন্দরে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আবার চীন পাকিস্তানে গোয়াদার বন্দর নির্মাণ করেছে এবং নৌঘাঁটি বানাচ্ছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ওই বন্দর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ইরানের বেলুচিস্তানে আরেকটা বন্দর তৈরি করেছে ভারত। সেখানে নৌঘাঁটি হবে কিনা আমার জানা নেই।

প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে গিয়েছিলেন দুই উপলক্ষে। প্রথমত, চীনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গ্রীষ্মকালীন সম্মেলনে যোগ দিতে, যেটি ডব্লিউইএফ সামার দাভোস হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে কিছু চুক্তি সম্পাদন করতে। সেখানে কয়টা ঋণচুক্তিও ছিল। ঋণচুক্তির ব্যাপারে ভারত-আমেরিকা তো সতর্ক করে দিয়েছে আবার মির্জা আজিজুল ইসলামসহ কিছু বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদও সরকারকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফর-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে সতর্কতার সঙ্গে সব পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জাতিকে অবহিত করেছেন। লেখার শুরুতে যে সাংবাদিকের প্রশ্নের কথা বলছিলাম তাকেও জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে। বাংলাদেশ নিয়মিতই তার ঋণ পরিশোধ করে ঋণ দাতাদের।

বলা দরকার, কোনো ঋণচুক্তি হওয়ার আগে ঋণদাতা আর ঋণগ্রহিতার মাঝে ব্যাপক আলোচনা হয়। ঋণের পরিমাণ, ঋণের সুদ, ঋণ পরিশোধ পদ্ধতি, গ্রেস পিরিয়ড- সবই লিপিবদ্ধ হয় উভয়ের সম্মতিতে। সুতরাং এখানে ফন্দিফিকিরের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। মালয়েশিয়ার সঙ্গে চীনের একটা রেল প্রকল্পে ঋণ প্রদান ও স্থাপনের বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল। রটনার প্রভাবে পড়ে মালয়েশিয়া সে চুক্তি স্থগিত করেছিল। এখন মালয়েশিয়া পুনরায় সে চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলছে। পরস্পরের সাহায্য ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। চীনের এত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের একান্ত সহযোগিতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর চীনা জাতির কঠোর পরিশ্রমের ফলে। মাও সে তুং জীবনে একবার শুধু বিদেশ সফর করেছিলেন আর তার এ সফর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। সে সফরে মাও স্টালিনের সঙ্গে সহযোগিতার সব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন, যা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

আমরা চীনের একটি সৎ গুণের বিষয়ে অবগত আছি যে, চীন কখনো কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে না, যা অন্যান্য বড় শক্তি করছে। পাকিস্তানে কত কিসিমের সরকার প্রতিষ্ঠা হলো। তাতে পাক-চীন সম্পর্কের কোনো হেরফের হয়নি। চীনের এ বিষয়ে কখনো কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না। আমাদের কয়লাভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র শিগগিরই উৎপাদনে যাচ্ছি। সুতরাং ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ, সাবস্টেশন নির্মাণ ইত্যাদি প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় ঋণ চুক্তি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু চীনের ‘ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’র কথা প্রচারিত আছে, আমরা এমন কোনো ট্র্যাপে পা বাড়ালাম কিনা তা অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেও পারে। আসুন খতিয়ে দেখি। প্রথমে দেখা দরকার আমরা যে ঋণ নিচ্ছি তা শোধ করার ক্ষমতা আমাদের আছে কিনা, না কি আমরা ঋণ করে ঘি খাচ্ছি? আমরা ঋণ এবং সুদ কিস্তি আকারে পরিশোধ করি। এখন বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশকে প্রতি বছর কিস্তি ও সুদের যে টাকা পরিশোধ করতে হয় তা আমাদের রপ্তানি আয় আর রেমিট্যান্সের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। বর্তমান বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চিত হতে পারে যে ঋণের ভারে বাংলাদেশকে কোনো কিছু হারাতে হবে না। এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং যে যেখানে আছেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম করা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।