দুর্নীতিই কী এসকে সিনহার কাল হলো!

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০১:১৬ পিএম, ২৮ জুলাই ২০১৯

অবশেষে কানাডায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়প্রার্থী হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)। অর্থাৎ আমেরিকায় তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় বেশি দিন টিকলো না। কারণ তিনি নিজের দেশে একটি উচ্চ পদে আসীন হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছিলেন।

আমেরিকার নিউ জার্সিতে তিনি বসবাস করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন দীর্ঘদিন ঝুলে থাকায় সম্প্রতি সেখানকার বাড়ি, গাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। আমেরিকা সিনহার বক্তব্য ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে জানিয়ে দিয়েছে। প্রমাণ হলো তিনি সৎ নন, ৪ কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা যথার্থ।

যা নন তাই দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি, নিজেকে জাহির করেছেন কখনো বা। আসলে তিনি আর্থিক ও মানসিক দিক থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি। আমেরিকায় অবস্থানকালে প্রকাশিত তাঁর লেখা গ্রন্থটি পাঠ করলে বোঝা যায়, তাঁর চিন্তাধারা সর্বাংশে অপকর্মে পূর্ণ। ২০১৭ সালের ২ অক্টোবর ছুটিতে যান তৎকালীন সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। পরে বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

২০১৭ সালে ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাত্রার পরদিনই তাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, অর্থপাচারসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনে সুপ্রিমকোর্ট। ২০১৭ মালের ১৪ অক্টোবর তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে আর্থিক অনিয়মসহ দুর্নীতির কথাও বলা হয়। ওইদিনই পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে বলে মনে করেছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। যা পরে স্পষ্ট হয়েছে দুদকের অনুসন্ধানে।

দুই.
চলতি মাসে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদের সূত্র থেকে জানা যায়, ভুয়া ঋণপত্র তৈরির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা আত্মসাত, পাচার করা ও পাচারের চেষ্টার দায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বলা হচ্ছে, আইন অনুযায়ী মামলার আসামিরা দেশের বাইরে থাকলেও দেশে এনে বিচারের চেষ্টা করবে দুদক। ১০ জুলাই(২০১৯) দুদক সচিব জানান, এই প্রথমবারের মতো কোন সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২), (৩) ধারায় মামলা করা হয়। মামলায় ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শুলশান শাখা ও প্রধান কার্যালয়কে ঘটনাস্থল বলা হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘটনার সময় দেখানো হয়েছে। এসকে সিনহা ছাড়া মামলার বাকি আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) সাবেক এমডি একেএম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মোঃ শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।

এর আগে ২০১৮ সালেরর অক্টোবরে ফারমার্স ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্ট থেকে চার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কথিত ব্যবসায়ী শাহজাহান ও নিরঞ্জন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে চার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিলেন। সেই টাকা রণজিৎ চন্দ্র সাহার হাত ঘুরে বিচারপতি সিনহার বাড়ি বিক্রির টাকা হিসেবে দেখিয়ে তার ব্যাংক হিসাবে ঢুকেছে বলে অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তে নামে দুদক এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা অভিযুক্ত হন। কারণ তিনি ভুয়া ঋণপত্র সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থ পাচারের চেষ্টা ও আত্মসাত করেছেন।

আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করলেও প্রধান আসামি সিনহার এ্যাকাউন্টে একটি পে অর্ডারের মাধ্যমে টাকা রাখা হয়। এ অর্থের মূল উৎস গোপন রাখা আইনের চোখে অপরাধ হওয়ায় মামলা হয়েছে যা অর্থপাচার ও পাচারের চেষ্টা হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকে পরিশোধ করা হয়নি যা দুদক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

কেবল আর্থিক কেলেঙ্কারি নয় চিন্তাধারায় ভুল পথের পথিক হচ্ছেন এসকে সিনহা। ৪ জুলাই সিনহা ফোর্ট এরি সীমান্ত দিয়ে আমেরিকা থেকে কানাডায় প্রবেশ করেন এবং শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়াকে সিনহা বলে বেড়াচ্ছেন, তিনি অ্যাকটিভিস্ট বিচারক ছিলেন বলেই টার্গেটে পরিণত হন। তাঁর রায়ে আমলাতন্ত্র, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও সন্ত্রাসীরা ক্ষুব্ধ হন। তিনি এখন দেশের শত্রু, সরকার তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে- প্রভৃতি।

মূলত বাংলাদেশ ছাড়ার পর থেকেই এসকে সিনহা দেশ সম্পর্কে অসত্য বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। অথচ দেশে ফেরার ব্যাপারে তাঁর ওপর কোনো হুমকি নেই। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনার আবেদনকে পোক্ত করার জন্যই তিনি এসব মিথ্যা বক্তব্য দিচ্ছেন। অথচ ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় নিজ বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আমি অসুস্থ না, আমি ভাল আছি, আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়নি।

আমি নিজে থেকেই ছুটি নিয়েছি। আমি একটু বিব্রত, আমি বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। আমি চাই না, বিচার বিভাগ কলুষিত হোক। বিচার বিভাগের স্বার্থে আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। কারও প্রতি আমার কোন বিরাগ নেই। বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকুক, এটাই আমি চাই।’ তাঁর ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা এখন শরণার্থী হওয়ার বাসনায় নিমজ্জিত। বিচার বিভাগকে পরিচ্ছন্ন রাখার প্রত্যাশা এখন দুদকের জালে তাঁর দুর্নীতির মামলায় আবদ্ধ। হায়রে আমাদের উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদের মর্যাদাশীল ব্যক্তিদের অবস্থান? নিজের দেশের অর্থ-সম্পদে পরিপুষ্ট হয়ে অবশেষে বিদেশের মাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? এই সৌভাগ্যের মূল কারণ নিজের দাম্ভিকতা, নিজে স্বচ্ছ না থাকা।

তিন.
এদেশের জনগণের ভুলে যাবার কথা নয় যে, এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্বগ্রহণের পর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে পুরাতন হাইকোর্ট চত্বর থেকে ট্রাইব্যুনাল সরানোর জন্য একাধিকবার আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রদান, সুপ্রিমকোর্টের বাৎসরিক ছুটি কমানোর সিদ্ধান্ত, আদালতের সময় এগিয়ে আনা, সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে বিতর্কিত ভাস্কর্য স্থাপন, বিচারপতি নিয়োগে পছন্দ মতো লোক না দেয়ায় বাধা সৃষ্টিগুলো অন্যতম।

এতে আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্তে করা যাবে না এমন চিঠি প্রদান, প্রধান বিচারপতির আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন কুসংবাদ মিডিয়াতে প্রকাশ পায়। এরপর সর্বশেষ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সংসদ নিয়ে তিনি যে পর্যবেক্ষক দিয়েছিলেন, তাতে দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আইনজীবী বিচারপতিগণও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অসুস্থ হওয়ায় রাষ্ট্রপতির নিকট এক মাসের ছুটির আবেদন করেন। ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া যাবার প্রাক্কালে তিনি যে বিবৃতি দেন তা নিয়েও বিতর্কের জন্ম হয়।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের আগে তাঁকে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ যখন শেষ তখন ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকার। তাদের আমলে তিনি স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। আবারো ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। এজন্য আপিল বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতির পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনানির জন্য তখন আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা ১১ জনে উন্নীত করা হয়েছিল। এর আগে আপিল বিভাগের বিচারপতির নির্ধারিত সংখ্যা ছিল ৭জন। আরো ৪ জনের পদ বাড়িয়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ কয়েকজনকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হওয়ার আগে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠায় শেখ হাসিনার সরকার।

চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার পরপরই তাঁকে জাতির পিতা হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য গঠিত ৫ বিচারপতির বেঞ্চে বিচারক হিসেবে মনোনীত করা হয়। তখন তিনি ছিলেন আপিল বিভাগের সর্ব কনিষ্ঠ বিচারপতি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২০১৫ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। আশ্চর্য হলো, একজন শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিকে সরকার যে সুযোগ দিয়েছিল তার পুরোটাই বিফলে গেছে- এসকে সিনহা এখন অন্য দেশের শরণার্থী হতে যাচ্ছেন।

চার.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে বিচারপতি সিনহাকে বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ পদে নিলেও তিনি তাঁর ‘মান রাখতে’ পারেননি। এটিই যথার্থ কথা। কারণ প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে আমাদের এখন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এমএস

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে বিচারপতি সিনহাকে বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ পদে নিলেও তিনি তাঁর ‘মান রাখতে’ পারেননি। এটিই যথার্থ কথা। কারণ প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে আমাদের এখন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।