করোনার চেয়েও শক্তিশালীদের দিনলিপি

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১২:০৩ পিএম, ২০ মে ২০২০

মাকে কবর দিয়ে সন্তানেরা বাড়ি ফিরে দেখে বাবাও নেই। এই হতভাগ্যরা হলেন চাঁদপুর শহরের চিত্রলেখা এলাকার রাবেয়া ও তার স্বামী গণপূর্ত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান পাটোয়ারী। এটাই করোনার ধর্ম। এমন মৃত্যু জাতশত্রুর জন্যও কাম্য নয়। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তি কখনও ভাবেননি তার লাশের পাশে আসবে না কোনো স্বজন। তার জানাজায় থাকবে না কোনো মুসল্লি। শেষবারের মতো একনজর দেখতে ভিড় করবে না কেউ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত ব্যক্তির দাফন হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। এই ব্যক্তির দাফন-কাফনে তার স্বজনদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি হয়নি জানাজাও।

চাল নিয়ে চালবাজি চলছিল গত মাস কয়েক থেকেই। সেটার সঙ্গে যোগ হয়েছে ত্রাণের চাল চুরির উৎসব। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক হুঁশিয়ারি এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার- দলীয় পদ থেকে বিদায় করার পরও এরা দমছে না। করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায়দের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া অর্থসহায়তায় থাবা দিতেও এদের বুক কাঁপছে না। করোনার চেয়েও শক্তিমত্তায় চুরি-চামারি অব্যাহত রেখেছে এই চাটারা। দিনকে দিন অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় আর স্বচ্ছতা আনা যাবে কি-না, বলা যাচ্ছে না। সারাদেশে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য চাল চুরি করে ধরা পড়েছে। চুরির সামান্য অংশ ধরা পড়েছে। আবার ত্রাণ চুরির সঙ্গে পথে ত্রাণের মালে গরিব মানুষের হানা দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এটা চরম অশনিসংকেত।

বিজ্ঞাপন

মরণঘাতী বিমারির ঘটনা পৃথিবীতে এই প্রথম নয়। তবে ধরনে এবার ভিন্নতা। আগে এই রকম ঘটনায় গরিবরা কেবল মরত। ধনীরা অর্থজোরসহ নানা পথে পার পেয়ে যেত। এবার সেটা হচ্ছে না। সর্বব্যাপী করোনা কাউকে ছাড়ছে না। ভীষণ নিরপেক্ষতায় ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কাউকে আক্রান্ত করছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সিঙ্গাপুর, লন্ডন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বাঁচার সম্ভাবনা কম। লকডাউনে সেই সুযোগই তো নেই।

বলা হয়ে আসছে করোনা একদম নিরপেক্ষ। কোনো বাছবিচার নেই। যাকে পায় তাকেই খায়। কিন্তু কিছু ঘটনায় তার এই বৈশিষ্ট্যে ছেদ পড়ছে। বিশেষ করে ত্রাণচোরসহ লুটেরা, অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা, ধর্ষক প্রজাতিকে করোনায় হানা দেয়ার তথ্য কম। বিভিন্ন এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার মোজে আছেন। করোনার জাত ভাইয়ের মতো পরাক্রমশালী হয়ে তারা ঠিক করে দিচ্ছেন তার এলাকায় কে কে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। কার কার পেটে ক্ষুধা আছে। অনেক ঘটনা জানার পরও করোনাদেরই সহায়ক ভূমিকায় প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আবার যাদের বীরত্ব ও ত্যাগের বিনিময়ে করোনা টিনএজ পার করে যৌবনের চোখ রাঙানিতে দাবড়ে বেড়াচ্ছে সেই শ্রেণিটিও বেশ অধরা। কেউ তাদের দাবায়ে রাখতে পারবে বলে মনেও হচ্ছে না। ভাবসাবে তারা আসলেই করোনার চেয়ে শক্তিশালী। তারা যেন করোনাকে বস্তাবন্দি করে ফেলছে। করোনার সাথে ঘরবসতি গড়ে দিব্যি ভালোই আছে। সরকারের শৈথিল্য কৌশলকে পাল্টা কৌশল হিসেবে নেয়ার লোকজনও কম নয়। সরকার বা এই জনগণ কেউই করোনাকে ভয় পায় না। আর যারা করোনার ভয়ে ঘরে বসে আছে তারা সরকারের নীতিকৌশল প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না। সরকারও এদের গোনে না। গোনার দরকারও নেই।

পরিস্থিতিটা সরকারের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। যত দোষ নন্দঘোষ জনগণের ওপর চলে আসে নিমিষে। এই জনগণ মানে কখনও প্রবাসী, ডাক্তার-নার্স, কখনও মুসল্লি ইত্যাদি। দাবি মতে, সরকার করোনা মোকাবিলায় তিন মাস আগে থেকেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। পর্যাপ্ত মাস্ক, পিপিই, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, টেস্ট কিট, ল্যাব না থাকলেও মন্ত্রী-এমপিদের মজাদার বিনোদন ছিল। আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে করোনায় কোনো ভয় নাই, করোনা সর্দি-কাশির মতো মামুলি ব্যাপার- এ ধরনের বচন সাপ্লাই হয়েছে ননস্টপে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে যখন ব্যাপক জনসমাগম এড়িয়ে চলার প্রেসক্রিপশন মানা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তখন অর্থাৎ ফ্রেব্রুয়ারির ১ তারিখে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কমিশনার নির্বাচন আয়োজন করা হয়। এই নির্বাচন আয়োজনে সচেতন জনগণ প্রতিবাদ জানালে নির্বাচন কমিশনার ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মতো জানান যে, নির্বাচনে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চট্টগ্রামে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বাতিল করা হয়। কিন্তু তার আগেই চলে ব্যাপক জনসমাগম ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হবার পরও অর্থাৎ ২১ মার্চ গাইবান্ধায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনী এলাকাতেই পরবর্তীতে করোনা পজেটিভ রোগী পাওয়া গেছে। মার্চের ৮ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম তিনজনের করোনা ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে সচেতনমহল থেকে লকডাউনের তাগিদ আসে। কিন্তু সরকার থেকে একে বলা হলো, গুজব-ভীতি ছড়ানো হচ্ছে। কিছু ধরপাকড়ও চলল। জানানো হলো- করোনা নিয়ে ভীতি ছড়ালেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এরপর ১৭ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। জাতির পিতার জন্মদিনের কেককাটা আর আতশবাজি উৎসবে ব্যাপক জনসমাগম। এই জনসমাগম নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলল এবং আবারও লকডাউন চাইল তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ। জাতির জনকের জন্মদিন পালনের পরদিনই সবকিছু বদলে গেল। যেন ১৮ মার্চ হঠাৎ করেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গুণ আকাশ থেকে অবতরণ করল।

তবে ১৯ মার্চ একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানালেন, লকডাউন করে ভীতি ছড়ানোর মতো পরিস্থিতি এখনও হয় নাই। সচেতন জনগণ ফের লকডাউন চাইল। এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এর আগে থেকেই দেশে ফিরে আসছিলেন। সংক্রমণরোধে তাদের জন্য বিমানবন্দরে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও সরকারি উদ্যোগে কোয়ারেন্টাইনের দাবি তোলা হলো। সরকার থেকে নিশ্চিত করল করোনা নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরে থার্মাল মেশিন বসানো হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরই জাতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেল, বিমানবন্দরে বসানো সবগুলো থার্মাল মেশিন নষ্ট। গণমাধ্যম আরও জানাল, বিমানবন্দরে মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে করোনামুক্তির সার্টিফিকেট। অতএব যত নষ্টের গোড়া জনগণই। সরকারের প্রস্তুতির অভাব, সমন্বয়হীনতা এবং সীমাহীন ব্যর্থতার প্রায় সবই ঢেকে গেছে জনগণের দোষে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমদিকে করোনাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়ার পর স্বীকার করলেও প্রবাসীদের যথাযথ পরীক্ষা না করা, পোশাক শ্রমিকদের একবার অরক্ষিত অবস্থায় ঢাকার বাইরে পাঠানো, আবার ঢাকায় নিয়ে আসার মাধ্যমে পুরো দেশকে বিপজ্জনক করে তোলা হলো। তারওপর চিকিৎসকদের প্রতিপক্ষ করাও বাদ যায়নি। এর মাঝেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সিলেটে গরিবের ডাক্তারখ্যাত মঈন উদ্দিনের। একজন মঈনের চলে যাওয়া আর ডা. মঈনের চলে যাওয়া এককথা নয়। ডা. মঈনের চলে যাওয়ার মধ্যে অনেক বার্তা মেলে। আরেকজন মঈনের চলা যাওয়ার আগে অবনত মস্তকে ভুল তথা বাস্তবতা স্বীকার করে প্রস্তুতি নিন। আড়াল করার মানসিকতা বাদ দিন। উন্নত দেশও যখন অসহায় তখন লুকোচুরির কী দরকার? তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।

১৯৭১ স্মরণ করলে দৃশ্যপটে ভাসে এক বাহিনী মারে, আরেক বাহিনী লুট করে। একদল দেশের তরে যুদ্ধ করে, অন্যদল রাজাকারি আর সন্ধি করে। ২০২০ সালের সঙ্গে কিছুটা মেলে। এক বাহিনী গরিব পোষে, আরেক বাহিনী গরিব চোষে। একদল ধারকর্জে অন্ন বিলায়, অন্যদল ত্রাণ কেড়ে নেয়।

করোনাভাইরাসের এ কঠিন সময়ে জনপ্রতিনিধিদের দেখা না পেলেও তাদের কারও কারও চুরি-চামারির খবর দেখছে-শুনছে মানুষ। এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানসহ তাদের অনেকে ঢাকায় আয়েশে সময় কাটাচ্ছেন। স্থানীয় সরকারের কেউ কেউ জেলা সদরে নিরিবিলিতে নিজে বাঁচলে পরের নাম তত্ত্ব অনুযায়ী গা ঢাকার মতো থাকছেন। আর এলাকায় থাকাদের কয়েকজন মশগুল ত্রাণবাজিতে। গতি পাল্টে করোনাকেও অন্যের বাড়ি চিনিয়ে দিতে যেন পারঙ্গম তারা।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।