নারীর নিরাপত্তা ও প্রাসঙ্গিক কথা

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মাত্রা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। শিশু থেকে বয়স্ক কোনো নারীই নিরাপদ নয় ধর্ষকদের থাবা থেকে। নারীরা যেন আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, গৃহবধূ এমনকি অবুঝ শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বছরের শুরুতে বনানীতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মাত্র ক’দিন আগে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের এক প্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের এই ভয়াবহতা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে।

আজ মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষিত হওয়ার সংবাদও পাচ্ছি আবার মসজিদে আরবি পড়তে গিয়ে ইমাম কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষিত হওয়ার সংবাদও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় পবিত্র স্থান মসজিদের ভিতরে ইমাম কর্তৃক কিশোরী ধর্ষণের সংবাদও পাওয়া যায়। ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফি নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা তা যেমনি নিষ্ঠুর-নৃশংস, তেমনি হৃদয়বিদারক। এছাড়া শিশু বলাৎকারের ঘটনা তো অহরহ ঘটছেই। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না বরং ধর্ষিতাকে হত্যা, মাথা ন্যাড়া করে দেয়াসহ নানান ধরণের নির্যাতনও করা হচ্ছে।

কার ওপর নির্যাতন এবং কাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? একজন নারী কখনও মা, কখনও বোন, কখনওবা স্ত্রী। নারী নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। পত্রপত্রিকার হেডলাইন নারী নির্যাতনের খবর দিয়ে শুরু হয়। একটি জাতীয় অনলাইন পোর্টালে শুধুমাত্র দু’দিনে (২৮-২৯ সেপ্টেম্বর) বেশ কয়েকটি ধর্ষণের সংবাদ পাই। সংবাদের শিরোনামগুলো ছিল এমন-সাভারের আশুলিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের কক্ষে তরুণীকে ধর্ষণ করলেন চেয়ারম্যান। বাসায় আশ্রয় দিয়ে তিন তরুণীকে ধর্ষণ। ঘুমের ভেতর কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ। কোম্পানীগঞ্জে নিজ ঘরে ধর্ষণের শিকার শিশু। চকলেটের লোভ দেখিয়ে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণ।

আমাদের সবার জানা আছে, কয়েক বছর আগে দিল্লিতে চলন্ত বাসে ৬ নরপশুর গণধর্ষণের কবলে পড়ে মেডিকেল ছাত্রির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা শুধু ভারতকেই নয়, বরং কাঁপিয়ে দিয়েছিল গোটা উপমহাদেশ ও বিশ্ববাসীকে। জাতিসংঘের মহাসচিব স্বয়ং গভীর শোক প্রকাশ করেছিলেন তার মৃত্যুতে। তার পরিবারসহ গোটা বিশ্বের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি। ভারতে এর জন্য প্রচলিত আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আইনে দণ্ডিত ধর্ষকের ফাঁসি অথবা রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগে খোজা করে দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে আইন রয়েছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কঠোর আইন আছে তবে এই আইনের কার্যকারিতা তেমন একটা দেখা যায় না, যার ফলে দিনের পর দিন ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সর্বত্র।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৮০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলা শেষ করার কথা বলা আছে; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। আলোচিত কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে এলে কিছুদিন সেটি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তা দেখা যায়। এর মধ্যে অন্য একটি নতুন ঘটনা আসতেই চাপা পড়ে যায় এসব ঘটনা। এরপর বছরের পর বছর ফাইলবন্দি অবস্থায় এসব মামলা পড়ে থাকলেও কোনো সুরাহা হয় না। এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে উঠছে ধর্ষক অপরাধীরা।

বর্তমান নারী নির্যাতনের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এসব ঘটনা মনে হয় সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সিনেমার পর্দায় এমন কিছু দৃশ্য থাকে যা দেখে চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে আসে কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবাই তা ভুলে যায়। ঠিক তেমনি সমাজ ও দেশে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য হৃয়বিদারক, মর্মান্তিক, নৃশংস ঘটনা ঘটছে কিন্তু এই ঘটনাগুলোও ক্ষণিকের জন্য আমাদেরকে আন্দোলিত করে। ক’দিন পরে সেই ঘটনা যেমন ভুলে যাই তেমনি অপরাধীদের বিচার নিয়েও হৈ চৈ কমে যায় আর অনেক ক্ষেত্রে তারা মুক্তও হয়ে যায়। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়।

মানবাধিকার সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, চলতি ৯ মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় হাজারখানেক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক তথ্যে দেখা গেছে, জুলাই মাসে ১০৪ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩২ জন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৫০ জনকে। এ ছাড়া জুনে ১৪ গণধর্ষণসহ ১০৭ ও মে মাসে ২৫ গণধর্ষণসহ ১০১ নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এক আলেম বন্ধু আলাপচারিতার একফাকে বলছিলেন, ‘সারা দেশে ধর্ষণের মত জঘন্য কাজ অহরহ হচ্ছে, আমরা আলেম সমাজ এর প্রতিবাদে কি ভূমিকা পালন করছি? আমরা তো প্রায় সময় দেখতে পাই দেশের বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনগুলো ভাস্কর্য অপসারণের বিরুদ্ধে, আহমদিয়াদেরকে অমুসলমান ঘোষণা করার জন্য, নাস্তিকদের শাস্তি এবং মুরতাদ ঘোষণাসহ নানান বিষয়ে দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে রাজ পথ বন্ধ করে। ইসলামি দলগুলো বিভিন্ন দাবি দাওয়া জানিয়ে মহাসমাবেশও করে থাকে অথচ সারা দেশে ধর্ষণের মত হারাম কাজ অহরহ ঘটছে, আর এর প্রতিবাদে আমরা কি করছি?

যারা এসব অন্যায় করছে তারাও তথাকথিত মুসলমানই। প্রশ্ন হচ্ছে, নারী নির্যাতনের বিষয়ে ইসলামি সংগঠনগুলো নিশ্চুপ কেন? ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আলেম সমাজ আন্দোলন চালিয়ে যাব বা আমরা রাজপথ ছাড়ব না, এ ধরনের কোনো আন্দোলনও তো আমরা দেখছি না।’ তা যাই হোক, কে আন্দোলন করল বা করল না তা আলোচনার বিষয় আমার না। আমরা চাই আমাদের নারীরা নিরাপত্তার সাথে সর্বত্র চলাফেরা করবে।

আমরা মনে করি দেশের আইন যদি তার সদিচ্ছা নিয়ে নারী ও শিশুর পাশে দাঁড়ায়, ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব অর্থেই বিবেচনা করে তাহলে আমাদের বিশ্বাস, নারী ও শিশুর নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে। বিশেষভাবে দল-মত-পেশা-প্রভাব কোনো কিছুই যেন ধর্ষকের বিচারের অন্তরায় না হতে পারে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। একই সাথে ঘটনার শিকার নারীকে যথাযথ সহায়তা ব্যবস্থার পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের আইন বিভাগের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা জারি থাকবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।