তারেক রহমানের ১৭ মিনিটের সেই ভাষণ

গৎবাঁধা রাজনীতির বাইরে এক নতুন বারতা

চিররঞ্জন সরকার
চিররঞ্জন সরকার চিররঞ্জন সরকার , কলামিস্ট ও লেখক
প্রকাশিত: ১১:২০ এএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

রাজনীতির চেনা ছক ভেঙে ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দিলেন তারেক রহমান। দীর্ঘ দেড় যুগের প্রতীক্ষা শেষে সংবর্ধনার মঞ্চে তিনি যে ১৭ মিনিটের বক্তব্য রাখলেন, সেখানে পেশিশক্তির আস্ফালন কিংবা প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কোনো প্রয়াস ছিল না। নেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের সস্তা রাজনীতি। আর এই ‘না’ থাকাটাই তাঁর বক্তব্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ধ্বংসাত্মক ভাষার পরিবর্তে গঠনমূলক ও ইতিবাচক রাজনীতির যে বীজ তিনি বপন করেছেন, তা সমকালীন রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর এই সংযত ভঙ্গি এবং দূরদর্শী কথাগুলো দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে, যা সর্বমহলে দারুণভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

তারেক রহমানকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তা হঠাৎ করে জন্ম নেওয়া কোনো আবেগ নয়; বরং দীর্ঘ হতাশা ও অনিশ্চয়তার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক ধরনের মানসিক আশ্রয়। ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পর মানুষ যে গভীর পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল, বাস্তবে তার খুব সামান্যই প্রতিফলন ঘটেছে। যারা রাজপথে নেমেছিল, যারা ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তাদের একটি বড় অংশ আজ নিজেকে প্রতারিত মনে করছে। কারণ আন্দোলনের পর যে রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা প্রত্যাশিত সংস্কার বা স্থিতিশীলতার বদলে নতুন করে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তিই সামনে এনেছে।

বিশেষ করে আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা কিছু শক্তির আচরণ, কথাবার্তা ও রাজনৈতিক ভাষা সাধারণ মানুষের মনে আস্থা নয়, বরং ভয় ও বিরক্তি তৈরি করেছে। দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পরিবর্তে হঠকারী সিদ্ধান্ত, প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য এবং ক্ষমতার দম্ভ জনমনে গভীর হতাশা জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মব সন্ত্রাস, বিচারবহির্ভূত চাপ সৃষ্টি এবং উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন নিরাপত্তাবোধকে মারাত্মকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পরিবর্তনের যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ আন্দোলনে নেমেছিল, তা ক্রমেই আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় রূপ নিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে মানুষ দ্রুত একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দেখতে চায়। কারণ তাদের কাছে নির্বাচন এখন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়; বরং স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একমাত্র পথ। দীর্ঘ অচলাবস্থা, অনির্বাচিত ক্ষমতা কাঠামো ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মানুষকে এতটাই ক্লান্ত করে তুলেছে যে, যে কোনো স্থিতিশীল রাজনৈতিক সমাধানই এখন আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে।

এই বাস্তবতায় তারেক রহমান অনেকের কাছে ‘ভরসার জায়গা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ধারণা তৈরি হয়েছে—তিনি দেশে ফিরলে দল সংগঠিত হবে, নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ হবে এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তার একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। এই প্রত্যাশা থেকেই তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে অনেকে আশাবাদের চোখে দেখছেন। এটি তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার চেয়ে বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক শূন্যতা ও মানুষের বিকল্প অনুসন্ধানেরই প্রতিফলন।

স্বাভাবিকভাবেই মানুষ জানতে আগ্রহী ছিল—এই তারেক রহমান কী বলেন, কীভাবে বলেন। দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতির পর তাঁর ভাষা, ভঙ্গি ও রাজনৈতিক অবস্থান কেমন হবে, সেটিই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য অনেকাংশেই জনমানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়েছে। উত্তেজক ভাষা বা প্রতিহিংসার সুর পরিহার করে তিনি যে সংযত ও পরিকল্পনাভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা অন্তত এই মুহূর্তে জনমনে স্বস্তির অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।

তার বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ বর্জনের আহ্বান। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি যে চরম মেরুকরণ এবং ‘বিজয়ী সব পায়’ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অর্জিত বিজয় যেন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কারণে কলঙ্কিত না হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি—যা দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত একটি দাবি।

এই বক্তব্যে তিনি নিজেকে কেবল একটি দলের নেতা হিসেবে নয়, বরং একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত অবস্থান থেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। সেখানে যেমন ছিল গত ১৫ বছরের বঞ্চনার বিবরণ, তেমনি ছিল আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনার রূপরেখা। মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’-এর অনুকরণে তিনি বলেছেন, ‘আমার একটা প্ল্যান আছে বাংলাদেশের জন্য’। এই ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বক্তব্য নিছক স্লোগান নয়, বরং একটি দিকনির্দেশনার ইঙ্গিত—যদিও সেই পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনো অস্পষ্ট।

বাংলাদেশের মানুষ এখন আর শুধু কথা শুনতে চায় না। তারা চায় বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিশ্চয়তা। তারেক রহমানের বক্তব্যে আশার জায়গা আছে, একই সঙ্গে সংশয়ের জায়গাও আছে। আশা—কারণ তিনি সংঘাত নয়, ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। সংশয়—কারণ অতীত খুব কাছের, এবং অতীতের দায় খুব বড়। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তারেক রহমান বদলেছেন—এই দাবি যাচাই হবে তাঁর কথায় নয়, কাজে। রাজনীতিতে রূপান্তর সম্ভব, কিন্তু বিশ্বাস ফিরে আসে খুব ধীরে। সেই বিশ্বাস অর্জনের কঠিন পরীক্ষাই এখন তাঁর সামনে।

বক্তব্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশগুলোর একটি ছিল বৈচিত্র্যময় সমাজের প্রতি তাঁর আহ্বান। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, পাহাড়-সমতল-সমুদ্রবেষ্টিত এই দেশ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সবার। এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন, যেখানে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিঘ্নে ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারবে। সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই অঙ্গীকার বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

যুবসমাজের প্রতিও তাঁর আহ্বান ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে। শক্তিশালী অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে তিনি সমষ্টিগত প্রচেষ্টার কথা বলেছেন। এসব বক্তব্য বিএনপির নেতৃত্বে নতুন গতি আনবে বলেই মনে করছেন অনেকে। বিশেষত রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হওয়ার এই সময়ে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন করে আস্থা ফেরাতে পারে—এমন আশাও দেখা যাচ্ছে।

তবে এই আশার পাশাপাশি প্রশ্নও কম নয়। এক সময় তারেক রহমান ছিলেন দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনীতিকদের একজন। দেশ ছাড়ার সময় তাঁর ভাবমূর্তি ছিল নেতিবাচক। ঘুষ, দুর্নীতি, দলীয় প্রভাব বিস্তার, এমনকি ‘প্যারালাল সরকার’ চালানোর অভিযোগও ছিল। এই অতীত ইতিহাস মুছে যায়নি। মানুষ ভুলেও যায়নি।

রাজনীতি কখনো স্থির থাকে না। সময় বদলায়। মানুষ বদলায়। পরিস্থিতিও বদলায়। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকাটা একজন রাজনীতিকের জন্য যেমন ক্ষতির, তেমনি আত্মসমালোচনার সুযোগও তৈরি করে। তারেক রহমান সেই সুযোগ নিয়েছেন কি না—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে তার বক্তব্যে আগের আগ্রাসী সুর ছিল না। ছিল না প্রতিহিংসার ভাষা। এটি একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। কিন্তু রাজনীতিতে বক্তব্য আর বাস্তবতা এক নয়।

তারেক রহমান বলেছেন পরিকল্পনার কথা। এটি ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেই পরিকল্পনা কী? দেশ গড়ার পরিকল্পনা মানে শুধু স্লোগান নয়। এর মানে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—সবকিছুতে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। নিরাপত্তার কথা বললে বলতে হবে—কার নিরাপত্তা? কীভাবে? কোন কাঠামোর মাধ্যমে? শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বললে বলতে হবে—ভিন্নমতকে কতটা জায়গা দেওয়া হবে? বিরোধীদের প্রতি আচরণ কেমন হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়।

তারেক রহমানের সামনে এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষা বক্তব্যের নয়। এই পরীক্ষা আচরণের। তিনি কি সত্যিই প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন? তিনি কি ক্ষমতায় গেলে ভিন্নমতকে সম্মান করবেন? তিনি কি দলীয়করণের রাজনীতি থেকে সরে আসবেন?

বাংলাদেশের মানুষ এখন আর শুধু কথা শুনতে চায় না। তারা চায় বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিশ্চয়তা। তারেক রহমানের বক্তব্যে আশার জায়গা আছে, একই সঙ্গে সংশয়ের জায়গাও আছে। আশা—কারণ তিনি সংঘাত নয়, ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। সংশয়—কারণ অতীত খুব কাছের, এবং অতীতের দায় খুব বড়।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তারেক রহমান বদলেছেন—এই দাবি যাচাই হবে তাঁর কথায় নয়, কাজে। রাজনীতিতে রূপান্তর সম্ভব, কিন্তু বিশ্বাস ফিরে আসে খুব ধীরে। সেই বিশ্বাস অর্জনের কঠিন পরীক্ষাই এখন তাঁর সামনে।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।