ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও উন্নয়নের শোকেসিং

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ০৪ জুন ২০২১

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উত্থান প্রদর্শন করছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ বের হয়েছে। ‘ফেস দ্য পিপল’ নামক অনলাইন পত্রিকায় নয়নিমা বসু লিখেছেন ‘বাংলাদেশ ইজ শোকেসিং ইটস্ ইকোনমিক রাইজ’ এবং বিভিন্ন সেক্টরের ‘রিপ-বেনিফিট’ প্রদর্শন করছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ কিছু প্রদর্শন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে বলে হয়তো ছবি বা ভিডিও করে দেখানোয় তা বিশ্বগণমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আর কতকাল সাগরের লোনা পানিতে ভাসবে? কতকাল অপরের দয়া ভিক্ষার জন্য হাত পাতবে? কতযুগ ফেলানীরা কাঁটা তারের বেড়ায় লাশ হয়ে ঝুলবে? এর তো একটা গ্রহণযোগ্য বা মানানসই সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের আর কোন দেশ থেকে এ ধরনের সংবাদ শিরোনাম শোনা যায়নি। আপাতত সংবাদটিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। কারণ সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের বিপদে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। নেপাল ও ভারতে দু’বার ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। ফিলিস্তিনে যুদ্ধাহতদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কাকে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতিতে ২০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। একটি দেশের নিজেদের কিছু না থাকলে অপরকে এ ধরনের সহায়তা কীভাবে দিতে পারে?

তবে কথাটা কি ‘শোকেসিং’এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি আরো কিছু অর্থবহন করবে? কারণ,শোকেস সাধারণত: বৈঠকখানা, দোকান বা জাদুঘরে রাখা হয়। আজকাল বৈঠকখানায় বা বসার ঘরে কোনকিছু প্রদর্শনের ব্যবস্থাকে ‘গেঁয়ো’ ভাবা হয়। আজকাল ‘শোকেসিং’ কথাটির সাথে কিছু নেতিবাচক শব্দ যেমন- অহংকার, ইর্ষা ও অপরকে হেয় করার প্রবণতা খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সহজ বাংলায় সেটা ‘ফুটানি’বলে প্রকাশ করার প্রচলন রয়েছে। কথাটা ‘মুই কি হনুরে- মোর বাড়িত প্রতিদিন মটর সাইকেল আইসে’- বলে বলে আমাদের গ্রামীণ সমাজে গত তিরিশ চল্লিশ বছর থেকে প্রচলিত ছিল। এরপর একসময় ‘গোলাম-বিবির বাক্স’নামে খ্যাত একটি গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত প্রচারণার ফলে সমাজে আরো বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। যদিও বাজার অর্থনীতিতে শোকেসিং কোন বিশেষ পণ্যের বাজার তৈরি ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর ব্রান্ডিং সম্পর্কে মানুষ কম পরিচিত।

যা হোক আমাদের অর্থনৈতিক উত্থান প্রদর্শন নিয়ে কিছু কথা ঘুরে ফিরে আসে। তা হলো আমাদের দেশের সুফলা মাটি ও কর্মঠ মানুষের অদম্য কর্মস্পৃহা। মূলত: এখনও কৃষিই আমাদের প্রধান উপজীব্য। কারণ, দুর্যোগ, মহামারি ঠেকাতে অন্যান্য সবকিছুই যখন বেসামাল তখন শহরে চাকুরি বা পেশা হারিয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে নিজ নিজ গ্রামে বাপ-দাদার পৈত্রিক জমিতে পুনরায় ঠাঁই নিতে হন্যে হয়ে ছুটতে দেখা গেছে। এই তো ক’দিন আগে জীবনের মায়া ত্যাগ করে লকডাউন উপেক্ষা করে পায়ে হেঁটে মানুষ রওয়ানা দিয়েছে গ্রামের নিজ ঠিকানায়। ঝড়-বৃষ্টি, করোনা মহামারীর আতঙ্ক এবং যাত্রাপথে যানবাহনের সংকট তাদেরকে রুখে দিতে পারেনি। বাঁচার জন্য কৃষিকাজের মধ্যে নিজেকে সঁপে দিতে মরিয়া হয়ে ছুটেছিল মানুষ। কারণ হতদরিদ্ররা চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। তারা উত্থান বা সোকেসিং ইত্যাদি কিছুই বোঝে না, দেখার সুযোগ পায় না, পেলেও দেখতে চায় না। তারা চায় গ্রামে পালিয়ে গিয়ে কোনরকমে নিজের জীবন বাঁচাতে।

কিন্তু আমাদের সেই কৃষির অবস্থা এখন কেমন? আমাদের দেশে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা পুরনো হিসেবে ৫৬%। বর্তমানে এই হার কত? কারণ প্রতিবছর নদীভাঙ্গনে অগণিত মানুষ ভূমিহীন হলেও সেই বছরে তা গণনা করা হয় না। আসলে আমাদের কৃষক কারা? শহরে বসবাসরত বিত্তশালীরা যদি জমির প্রকৃত মালিক হন তাহলে বর্গাচাষ করে কৃষক নামক দরিদ্র দিনমজুর নিজের ভাগে কি পান তা নিয়ে কোন সঠিক তথ্য কি কোথাও সংগৃহীত আছে? এ জন্যই ফিবছর নদীভাঙ্গা, জলোচ্ছ্বাসে উপকূল ক্ষয়ে যাওয়া গৃহহারা ভাসমান মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসকল বাস্তহারা মানুষ নিত্য বস্তি গড়ছে শহরগুলোর আনাচে কানাচে। এজন্য এক হিসেব মতে এখনও দেশে পৌনে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

আসলে আমাদের দেশে আমবাগান, লিচু বাগান, মাছের পুকুর, চিংড়ি ঘেরের মালিক কি কোন প্রান্তিক কৃষক? কোন প্রকৃত কৃষকের কি ফলের বাগান করার মত জমি ব্যবহারের ক্ষমতা আছে নাকি বাগান মালিকরা শহুরে ধনী শ্রেণির তার কি পরিসংখ্যান আছে? কৃষিপণ্য বিক্রি করে লাভের অংশ আসলে কাদের কাছে যায়? একথা সবাই স্বীকার করবেন যে, আমাদের দেশে কৃষকগণ আসলেই সবদিক দিয়ে বঞ্চিত একটি নিরীহ অসহায় শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। তাঁদের সিংহভাগই ভূমিহীন কৃষক বা শুধু কৃষিমজুর। যাদের বছরের বেশীরভাগ সময় কোন কাজ থাকে না, আয়ও থাকে না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে রিক্সা চালায়, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পাড়ি দেয় শহরে এবং শহরের ভাসমান জীবনে মিশে শহুরে দারিদ্র্য আরো প্রকট করে তোলে। তাইতো আমাদের শহুরে দারিদ্রের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এ সকল হতদরিদ্র মানুষকে গ্রামে রেখে দেবার পরিকল্পনা কোন কাজে আসছে না। সম্প্রতি জানা গেল, তাঁদের অনেকে আশ্রায়ণে ঘর বরাদ্দ পায়নি। কিন্তু তাদের নামে বরাদ্দকৃত সরকারী সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বিত্তশালীরা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। জবাবদিহিতা না থাকলে এবং এভাবে রক্ষক ভক্ষক হয়ে গেলে হতদরিদ্রাবস্থা কি কখনও এই দেশ থেকে দূর করা সম্ভব হবে?

ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডরের পর উপকূলের পুরাতন বেড়িবাঁধের সংস্কার ও নতুন বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর দেখা গেল উল্টে চিত্র। ইয়াসের তান্ডবে কয়েকশত মাইল বেড়িবাঁধ ধ্বসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঋণ করে ঘের বর্গা নেয়া কৃষকরা। চিংড়ি ঘেরসহ সমুদয় কৃষি ফসল লোনা পানিতে ডুবে মরে পঁচে লণ্ডভণ্ড হয়ে কৃষকরাই বেশি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। ইয়াসের তাণ্ডবে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই ভেসে গেছে ৭৫৬০টি মাছের ঘের। করোনার প্রভাবে কর্মহারা হয়ে যারা শহর থেকে গ্রামে ফিরে আশার আলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করছিল তারা এখন নতুন করে বজ্রাঘাতের মুখে পড়েছে। এদের সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে দ্রুত আর্থিক ক্ষতিপূরণ অথবা সুদবিহীন ঋণ দিয়ে বাঁচাতে হবে। তা করা না গেলে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে তারা নিরুপায় হয়ে ভাসমান হিসেবে শহরে পাড়ি জমাবে এবং শহুরে দারিদ্রাবস্থাকে আরো চরম, আরো প্রকট করে তুলতে পারে।

অন্যদিকে প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে যেতে যে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে বৈদেশিক রেমিটেন্স নিয়ে সংবাদের শিরোনাম শীঘ্রই উল্টো হতে পারে। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি হয়েছে ওদের পাঠানো টাকায়। তাই বিদেশ থেকে করোনায় নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরত আসা বা বেড়াতে আসা সকল শ্রমিককে দ্রুত আবারো বিদেশে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাবার পথ সহজ করে দিতে হবে। যারা কর্মহারা হয়েছেন তাদেরকে নতুন কর্মসংস্থান করে দিতে না পারলে আমাদের দেশে আরো বেশি পারিবারিক সহিংসতা ও স্ট্রীট গ্যাং অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে।

রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া ধনী এবং মেগা প্রজেক্টের টাকায় ফুলে যাওয়া কিছু মানুষের অতি চাকচিক্যময় জীবন যাপনের ফলে আমাদের বড় শহরগুলোতে চরম অসাম্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে শহুরে সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়ে সামাজিক ভাঙ্গন ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে। ওদের অবৈধ অর্থের প্রভাবে সম্প্রতি তরুণ-কিশোরদের হাতে চলে গেছে ভয়ংকর মাদক ক্রিষ্টাল ক্রেজ ও এলএসডি। সমাজে চরম বিশৃংখলা তৈরির অপেক্ষায় এসকল মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ দায়ী। সময়মত ওদরেকে ঠেকানা না হলে ওরাই পরস্পরকে ছুরিকাঘাত করবে, ওরাই ট্রাফিক আইন অমান্য করে শহরের দ্বিতল রাস্তায় অবৈধভাবে উঠে টিক্টক ভিডিও বানাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যেতে থাকবে।

১৯৯৮ সালে আমার অস্ট্রেলিয়ার একজন সহপাঠী টিভিতে ঘূর্ণিঝড়ের থৈ থৈ পানিতে উপকূলের মানুষকে ভাসতে দেখে আঁৎকে উঠে বলেছিল- তোমরা বার বার ঝড়ে ডুবে যাচ্ছ কেন? উঁচু জমি কিনে নেপালের দিকে যেতে পার না? বলা বাহুল্য সে কখনো বাংলাদেশে আসেনি। তাই তার নিজ দেশ থেকে আমাদের সম্পর্কে এমন বিরূপ ধারণা।

বাংলাদেশে এসে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়ে যদি ভাঙ্গা রাস্তায় তার গাড়ি কাদায় আটকিয়ে যায়, গুলশান বা কোন বড় মার্কেটের পাশে অনেকগুলো ভিখারী তাকে ঘিরে ধরে হাত পাতে তাহলে সে তার অনুভুতি কিভাবে প্রকাশ করবে তা বলাই বাহুল্য। মনে রাখতে হবে, সেই প্রকৃত বন্ধু যে তার বন্ধুর দোষ ও কষ্টগুলো সময়মত স্মরণ করিয়ে দেয়।

কোন দেশের উৎপাদিত কৃষিজাত বা শিল্পপণ্য ব্রান্ডিং করতে সোকেসিং-এর দরকার আছে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে বা বৈদেশিক বাজার ধরার জন্য। এত উক্ত পণ্যের একক মালিকানাস্বত্ব নিয়ে কারো কোন দাবী বা আইনী জটিলতা থাকলে তা প্রকাশ পায়। এটা সাধারণত: সেমিনার বা বাণিজ্য মেলায় করা হয়ে থাকে। কিন্তু নিজেদের দুঃসহ ট্রাফিক সামলাতে কয়েকটি উঁচু রাস্তা বানিয়ে, কয়েকটি ট্রেনের বগী কিনে উন্নয়ন প্রচারে টাকা খরচ করার সময় আমাদের এখনও আসেনি। আমরা নিজেরা ট্রেন বানাতে পারলে বা প্রকৃত উন্নয়ন হলে বিদেশিরা নিজেরাই একদিন দেখতে আসবে।

এ মুহূর্তে দেশের সকল হতদরিদ্র মানুষের কথা ভাবুন। এসময় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত প্রতিবিম্ব নয়। করোনার সময় ও করোনা পরবর্তীতে চরম হতদারিদ্র্য ঠেকানোর কার্যকরী কর্মসূচি হাতে নিন। সবাইকে দ্রুত টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করুন। নদীভাঙ্গা, ভাসমান ও ভূমিহীনদের জন্য যে সকল অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা তারা আসলেই হাতে পাচ্ছেন কি-না তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিন। তা করা না হলে বিদেশি গণমাধ্যম আমাদের উন্নয়নকে ‘ব্রান্ডিং‘ মূল্যায়ন না করে শুধু ‘শোকেসিং’বলে উপহাস করতে দ্বিধা করবে না বৈ-কি?

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।