রাজনীতি

আওয়ামী লীগের নার্ভাসনেস না ট্র্যাপ?

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০২২

ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশের সাফল্যে দারুণ চাঙ্গা বিএনপি। ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের ৬টি এরইমধ্যে শেষ করেছে বিএনপি। সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী হয়ে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় শেষ হবে বিভাগীয় সমাবেশের এ কর্মসূচি। অনেকদিন পর, আসলে বলা ভালো অনেক বছর পর বিএনপি মাঠে নেমে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করতে পারছে।

আর বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের কাউন্টার হিসেবে আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় সম্মেলন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনকেই সমাবেশে রুপ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপিকে মাঠ ছেড়ে দেয়া বা মিডিয়ার ফোকাস একতরফাভাবে তাদের দিকে টেনে নেয়ার সুযোগ দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে দারুণ চাঞ্চল্য রাজনীতির মাঠে।

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে লোকসমাগম কমাতে সরকারি দল বারবার একই কৌশল প্রয়োগ করছে। সমাবেশের দিন এবং তার আগের দিনে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে লোক আটকানোর চেষ্টা হয়েছে। তাতে লোক হয়তো কিছু কমানো গেছে। তবে যারা এসেছেন, তারা অনেক কষ্ট করে এলেও দারুণ উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে গেছে।

বাধা জয় করার উদ্দীপনাও ছিল। আর পরিবহন ধর্মঘটের সাথে মানিয়ে নিয়ে বিএনপির একদিনের সমাবেশ পরিণত হয়েছে তিনদিনের কর্মসূচিতে। পথের কষ্টটুকু তারা পুষিয়ে নিয়েছেন পিকনিক মুডে। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পরিবহন ধর্মঘটে ভোগান্তি শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদেরই পোহাতে হয়েছে, ব্যাপারটি তেমন নয়। ঐ বিভাগের সাধারণ মানুষ, এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

পরিবহন ধর্মঘটের অপকৌশলটুকু বাদ দিলে গত কিছুদিনের আওয়ামী লীগকে আমার অচেনা লাগছে। টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এর আগে বিএনপির ব্যাপারে এতটা সহিষ্ণু ছিল না। বিএনপি মাঠে নামলেই হামলা-মামলায় তাতের পর্যুদস্ত করাটাই এতদিন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।

অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগ ভালো হয়ে গেছে। সমাবেশের জবাব তারা সমাবেশ দিয়েই দিচ্ছে। রাজনীতি ফিরেছে রাজনীতির ধারায়। এটা ঠিক, আওয়ামী লীগ চাইলে বিএনপি টানা ৬টি সফল বিভাগীয় সমাবেশ করতে পারতো না। দল এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড করে দেয়ার অনেক অতীত উদাহরন আছে। বরং কেন যেন মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আসলে বিএনপিকে চাঙ্গা করার জন্যই পরিবহন ধর্মঘটের নাটক করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপিকে চাঙ্গা করে আওয়ামী লীগের লাভ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে পরে আসছি।

অনেকদিন ধরেই সরকারি দলের নেতারা বিএনপিকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছিল। বিএনপির সাথে জনগণ নেই, তাদের আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই, কোন ঈদের পর আন্দোলন- এ ধরনের কথা আমরা প্রায়ই শুনছিলাম। কিন্তু ৬টি সফল সমাবেশের পর এমন অভিযোগ করার আর সুযোগ নেই।

বিএনপি নেতারা বলছেন, বিএনপির সমাবেশের জনগণের জোয়ার দেখে সরকারি দল নার্ভাস হয়ে গেছে। এ কারণেই তারা নানা কূটকৌশলে সমাবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জনগণের জোয়ারে তাদের সব চেষ্টা বিফলে গেছে। কিন্তু হিসাবটা আমার কাছে অত সহজ মনে হচ্ছে না। টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এখন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে।

বিএনপির কয়েকটা সমাবেশ দেখে তাদের নার্ভাস হয়ে যাওয়ার কথা নয়। নার্ভাস হলে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সমাবেশ করতেই দিতো না। আগের স্টাইলে দৌড়ের ওপর রাখতো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগই চাইছে বিএনপি রাজপথে থাকুক, চাঙ্গা হয়ে উঠুক, আত্মবিশ্বাসী থাকুক। একদম বাধা না দিলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না বলেই আওয়ামী লীগ পরিবহন ধর্মঘটের নাটকটুকু করছে।

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ, মাঠে তৎপর হওয়া, নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা- সবই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে। কিন্তু তাদের মূল দাবি হলো, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। বর্তমান সরকারের অধূনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে তারা অনড়।

আবার এটাও ঠিক, আগামী নির্বাচনে অংশ ন নিলে টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। তবে সঙ্কটটা শুধু বিএনপির নয়। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আরেকটি এ ধরনের নির্বাচনের ঝুঁকি নেয়া আওয়ামী লীগের জন্যও বিপদজনক হতে পারে।

সম্প্রতি দলের একাধিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের এমপি ও নেতাদের জনগণের আরো কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আগামী নির্বাচন সহজ হবে না। বিএনপি নির্বাচনে আসবে এমনটি ধরে নিয়েই আসলে প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসবে না।

আর আওয়ামী লীগ চাইবে বর্তমান অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে আসুক। নিজেদের এই চাওয়া পূরণ করতে হলে আওয়ামী লীগকে মাঠের পরিস্থিতি বদলাতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে যে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সভা-সমাবেশ করতে গেলে কাউকে বাধা দেয়া হয় না। নির্বাচনের আগের বাকি একবছর এই পরিস্থিতি বজায় রাখতে পারলে বিএনপি উল্টো চাপে পড়বে।

দেশী-বিদেশী মহল তখন গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তাদের নির্বাচনে যেতে চাপ দেবে। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশ নেয়ার প্রস্তাবও দিতে পারে, যেমনটি দিয়েছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে। আওয়ামী লীগ তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে সেটি বিএনপির ওপর প্রবল চাপ তৈরি করবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, বড় বড় সমাবেশ বিএনপির মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস এনে দিতে পারে, যা তাদের নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করতে পারে।

সংবিধানে নেই, এই দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য যে কোনো ব্যবস্থায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারাটাই হবে আওয়ামী লীগের জন্য বড় বিজয়। আওয়ামী লীগের উদারতাকে বিএনপি নার্ভাসনেস মনে করলেও হতে পারে এটি তাদের জন্য ফাঁদ। এখন দেখা সামনের দিনগুলোতে বিএনপি আওয়ামী লগের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়, নাকি আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেয়।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য যে কোনো ব্যবস্থায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারাটাই হবে আওয়ামী লীগের জন্য বড় বিজয়। আওয়ামী লীগের উদারতাকে বিএনপি নার্ভাসনেস মনে করলেও হতে পারে এটি তাদের জন্য ফাঁদ। এখন দেখা সামনের দিনগুলোতে বিএনপি আওয়ামী লগের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়, নাকি আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।