ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের কথাও ভাবতে হবে

এরশাদুল আলম প্রিন্স
এরশাদুল আলম প্রিন্স এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশিত: ০৯:৩১ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩

 

কাজের খোঁজে প্রতিবছরই অনেক শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমান। আবার প্রতিবছর ফিরেও আসেন অনেক শ্রমিক। অর্থনৈতিক সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সীমিত কর্মসংস্থানের জন্য অন্যান্য দেশেও কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। আবার কাজের সুযোগ থাকলেও জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহ করে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ওই সব দেশে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

দৈনন্দিন জীবনের নির্বাহ ও ইকামা বা ওয়ার্ক পারমিটের খরচ জোগাড় করার পর সঞ্চয় বা দেশে পাঠানোর মতো কিছু আর থাকে না। তাই অনেকে দেশে ফিরে আসছেন। সেই সাথে মাথায় ঋণের বোঝা। ধারকর্য করে বিদেশে যাওয়ার পর ধার শোধ করতেই লেগে যায় কয়েক বছর। কাজেই, দারিদ্র্য ও জীবনসংগ্রামের চক্র থেকে প্রবাসী শ্রমিকরা বের হতে পারেন না।

বিদেশে যেতেও তাদের অনেক টাকা ঋণ করে যেতে হয়। ভারত, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার এক কর্মীর যেখানে ১৫–২০ হাজার টাকা লাগে, সেখানে আমাদের একজন শ্রমিকের লাগে কয়েক লাখ টাকা। সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি সক্রিয় না থাকায় সে স্থলে সক্রিয় দালাল চক্রের জন্য এতো বেশি টাকা খরচ করে শ্রমিকরা বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

এক হিসাব বলছে যারা বিদেশে যায় তাদের ২০ শতাংশ কর্মী চুক্তি অনুযায়ী কাজ পায় না। তারা কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন না হয় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে জেলে দিন কাটাচ্ছেন। সাগর, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নেন জেলে। নারী কর্মীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। যৌন নির্যাতনের শিকার হন বেশি কিছু নারী শ্রমিকরা।

এভাবে নানা নির্যাতনের পর যারা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তাদের পাশে না আছে আমাদের সরকার, না রাষ্ট্র। অনেকে সংসার, প্রিয়জন, পরিবার সবই হারান। তাদের পাশে কেউ নেই। তাদের সংগ্রাম শেষ হয় না। বয়স যাই হোক, আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়।

অথচ তাদের পাঠানো টাকা নিয়ে আমাদের কতো দুশ্চিন্তা। টাকা বেশি পাঠালে রিজার্ভ ভালো, কম পাঠালে অবস্থা খারাপ। দেশের অর্থনীতির দুই বড় শক্তি হলো বৈদেশিক শ্রমিক ও দেশীয় পোশাক শিল্প। অথচ এই দুই খাতের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও বঞ্চিত। তাদের কোনো অভিভাবক নেই।

যে সব দালালের খপ্পরে পড়ে তারা বিদেশে গিয়ে সব হারান সেই সব দালালরা থেকে যায় হাতের নাগালের বাইরে। তাদের বিচার হয় না। বৈদেশিক শ্রমিকদের ৯৯ শতাংই যায় বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি এখানে অকার্যকর। বেশিরভাগ মানুষ বেসরকারি দালালদের মাধ্যমে যায় এটা যেমন সত্যি, তেমনি এদের মাধ্যমে প্রতারিতও হয় বেশি। কিন্তু এসব প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির সবাই যে অনিয়ম করে তা নয়। তবে, এক্ষেত্রে গুটি কয়েক অসাধু ব্যবসায়ীই যথেষ্ট। তাদের জন্য আমাদের পুরো প্রবাসী শ্রমিক শ্রেণি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি এজেন্সি যদি অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠায় তবে গ্রহণকারী দেশে বাংলাদেশের বদনাম নয়। একটি শ্রমবাজার নষ্ট হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট।

এদিকে সব হারিয়ে যারা দেশে ফিরে আসেন তারা আবার নতুন করে জীবন শুরু করা চেষ্টা করেন। কিন্তু এ জীবন সংগ্রামে তাদের পাশে থাকে না সরকার ও রাষ্ট্র। এক হিসাব বলছে, বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ৪৭ শতাংশ কর্মী দেশে ফিরে আসছেন। প্রশ্ন হলো, বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ওইসব শ্রমিকরা বিদেশে গেলেন কীভাবে? রাষ্ট্র বা সরকারের কাজ কী? কাগজপত্র বৈধ না অবৈধ তা দেখার দায়িত্ব কার? যারা অবৈধভাবে বিদেশে শ্রমিক নিলো তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে কি? তাদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে কি? জরিমানা বা ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে কি? এ বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা, অধিদপ্তর ও বিদেশে বাংলাদেশের এম্বেসিগুলোকে এগিয়ে আসতে।

করোনার অভিঘাতের পরে বৈদেশিক শ্রম বাজারের স্থবিরতা এখনও কাটেনি। বিশ্বের বেশ কিছু শ্রম আমদানিকারক দেশ শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে, আমাদের অর্থনীতিতেও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। দেশে বাড়ছে বেকার সমস্যা। অর্থনীতির ওপর চাপও বাড়ছে।

মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে ফিরে আসা শ্রমিকরা কাজে ফেরা চেষ্টা করে। নতুন করে যে ব্যবসা করার পুঁজি তাদের নেই। চারদিকে পাওনাদারদের তাগাদা। হতাশ হয়ে পড়েন অনেক শ্রমিক। এই সব শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা নেই। তাদের প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক। সবাই তাদেরকে ব্যর্থ বলে মনে করে। এভাবে দেশে ফিরে আসার পর শ্রমিকরা নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। বিদেশে যাওয়ার পর দেশ, পরিবার ও সমাজ তাদের কথা ভুলে যায়, আবার ফিরে আসার পরও দেশকেও তারা পাশে পান না।

এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দেশে ও বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কাজ করছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। এই সংস্থা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়ন ও অভিবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করে।

শ্রমিকদের যথাযথ কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে এসব সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে ও বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য কাজ করাই এসব সংস্থার দায়িত্ব। কিন্তু তাদের তৎপরতা কদাচিৎ চোখে পড়ে। তাদের জনবল বা দক্ষতা ও কৌশলগত সীমাবদ্ধতা থাকলে তা কাটিয়ে উঠতে হবে।

জানা যায়, বিদেশে আমাদের ৩০টি শ্রম উইং আছে। এসব উইং আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ এর ২৪ ধারায় এসব উইং-এর দায়-দায়িত্বের কথা বলা আছে। কিন্তু আইনানুযায়ী এসব উইং কি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে?

অনেক প্রবাসী শ্রমিক পাওনা টাকা না নিয়েই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের পাওনা টাকা ফেরত পেতে প্রবাসী দূতাবাসগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ২০২০-২০২১ সালে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শ্রমিক ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তারা তাদের পাওনা টাকাও নিয়ে আসতে পারেননি। এরকম ঘটনা যদি এখনও ঘটে তাহলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এ টাকা পেলে দেশে ফিরে এসেও তারা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা করতে পারবেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকার থেকে তাৎক্ষণিক ঋণ বা অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণ হতে হবে অতি সহজ শর্তে। তাদের এককালীন অনুদান বা সহায়তা দেওয়ার কথাও ভাবতে হবে। ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য সরকার ২০২১ সালে ২০০ কোটি টাকার একটা ঋণ কর্মসূচি নিয়েছিল। সেখান থেকে বরাদ্দ হয়েছে ৫ শতাংশেরও কম। অনেক ফিরে আসা শ্রমিকরা এসব ঋণ সুবিধার কথা জানেও না।

ব্র্যাক, ইউএন ওমেন ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের এক যৌথ গবেষণা বলছে, অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশই দেশে চাকরি খুঁজেছেন। ফিরে আসা শ্রমিকদের জন্য সরকারি নানা প্রণোদনার সুযোগ থাকলেও তার সুফল পাচ্ছেন না শ্রমিকরা।

এছাড়া তাদেরকে শুধু ঋণ দিলেই হবে না। যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা না হলে তারা পুঁজি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারবেন না। কারণ, তাদের অধিকাংশই চাকরি করেছেন, ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই প্রশিক্ষণ ছাড়া টাকা দিলে সেই টাকারও যথাযথ ব্যবহার হবে না। উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাদের পুনর্বাসন কর্মসূচী নিতে হবে।

কাজেই, ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও সহায়তা করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকেও একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।

এইচআর/এমএস

ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও সহায়তা করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকেও একযোগে কাজ করতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।