ঔদ্ধত্য নয়, নম্রতাই মুমিনের ভূষণ

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:৪৪ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

ঔদ্ধত্য আর অহংকার পরিহার করা অনেক কঠিন একটি বিষয়। কেননা এটি এমন একটি মারাত্মক রোগ যার কবলে পড়ে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই ব্যাধিতে যে একবার আক্রান্ত হয় তার কাছে তখন আর অন্যায়কে অন্যায় মনে হয় না।

তবে একজন প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি সে যে-কোনো অবস্থায় গর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করে চলে। তার কথা, কাজ ও আচরণে কখনো অহংকার নয় বরং বিনয় প্রকাশ পায়। সে যতবড় নেতা এবং অর্থ সম্পদের মালিক হোক না কেন সবার সাথে তার ব্যবহার হয়ে থাকে নম্রতা আর বিনয় সুলভ।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করবে না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক; অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)

এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে এক কণা পরিমাণ অহংকার আছে সে কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ একজন সাহাবি (রা.) বললেন, যদি কেউ সুন্দর পোশাক ও জুতা পছন্দ করে? তিনি (সা.) বললেন, অহংকার বলতে আত্মাভিমানে সত্যকে অস্বীকার করা এবং অন্যকে হেয় চক্ষে দেখা বোঝায়।’ (মুসলিম)

পবিত্র কুরআন এবং হাদিস থেকে বিষয়টি স্পষ্ট, কোনো অহংকারীকে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। আমরা সাধারণত দেখি, অনেকেই এমন আছেন যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদ বা জ্ঞানের অধিকারী করেছেন তারা নিজেকে অনেক কিছু মনে করে আর অন্যদের কিছুই মনে করে না। তারা নিজেদের অর্থের, ক্ষমতার বা জ্ঞানের অহংকার করে।

প্রত্যেক পাপের মূলে রয়েছে ৩টি বিষয় তা থেকে আত্মরক্ষা করা উচিত, প্রথমত ঔদ্ধত্য থেকে বাঁচো, কেননা ঔদ্ধত্যই শয়তানকে প্ররোচিত করেছে, যেন সে আদমকে সেজদা না করে দ্বিতীয়ত লোভ সংবরণ করো কেননা এই লোভই আদম (আ.)কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে উসকিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত ঈর্ষা থেকে বাঁচো কেননা এই ঈর্ষার কারণেই আদমের দুই পুত্রের মধ্য থেকে একজন নিজের ভাইকে হত্যা করেছে।

তাদের অহংকারের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, সাধারণ লোকদের সাথে কথা পর্যন্ত বলতে তারা লজ্জাবোধ করে, সাধারণ মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না, মানুষের অসম্মান করে, এমনকি নিজ আত্মীয়-স্বজনের সাথে খারাপ আচরণ করতেও তারা দ্বিধা করে না।

সমাজে এমন অনেক মানুষকে আমরা দেখেছি, যাদের ক্ষমতা আর অবৈধ অর্থের দাপটে তাদের পা যেন মাটিতেই পরতো না। তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ তো দূরের কথা স্বাক্ষাৎ পেতে পায়ের জুতা ক্ষয় করেও অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা হয়ত ভেবেছিল, এই ক্ষমতা আর অবৈধ অর্থ দিয়েই তাদের চৌদ্দপুরুষ পার হয়ে যাবে। কিন্তু না। উপরে এমন একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি সবার প্রকাশ্য ও গোপন সব কর্মকাণ্ডের হিসাব রাখছেন।

মহানবি (সা.) বলেছেন, নম্রতা যে-কোনো বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। আর যে-কোনো বিষয় থেকে নম্রতা বিদূরিত হলে তাকে কলুষিত করে। (মুসলিম) তিনি আমাদেরকে ছাড় দেন ঠিকই কিন্তু তিনি একেবারে ছেড়ে দেন না। মানুষ যখন সীমা অতিক্রম করে ফেলে তখন আল্লাহপাক তাকে পাকড়াও করেন আর এমনভাবে তিনি পাকড়াও করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।

অতীতে আল্লাহপাক এমন অনেক জাতি ও তাদের নেতাকে এই অংহকারের কারণেই ধ্বংস করেছেন। তাদের কাছে ধন-সম্পদের কোনো কমতি ছিল না, স্থাপত্যশিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানেও তারা অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু তাদের মাঝে একটা জিনিসের অভাব ছিল, তারা নম্রতাকে ভুলে অহংকারের পথ ধরেছিল।

আদ জাতির বিষয়ে পবিত্র কুরআনে খুব সুন্দরভাবে উল্লেখ রয়েছে। এই আদ জাতি তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত না, তাদের ইমান ছিল না, তারা ছিল মূর্তিপূজারি, তারা নিজেদের নিয়ে অনেক অহংকার করত।

যেভাবে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আর রইলো আদ জাতির কথা। তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করে বেড়াতো এবং বলতো, শক্তিতে কে আমাদের চেয়ে বেশি প্রবল? তারা কি দেখেনি, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি শক্তিতে তাদের চেয়ে প্রবল? এরপরও তারা অনবরত আমাদের নিদর্শনাবলিকে অস্বীকার করতে থাকলো। অতঃপর আমি ভয়ংকর অশুভ দিনগুলোতে তাদের ওপর এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত করলাম যেন তাদের আমি এ পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাজনক আজাব ভোগ করাই। আর পরকালের আজাব অবশ্যই অধিক লাঞ্ছনাজনক আর তাদের সাহায্য করা হবে না।’ (সুরা হা-মিম সাজদা, আয়াত : ১৫-১৬)

আসলে মানুষের ক্ষমতার দাপট আর অহংকার আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি থেকে তাকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। সে শয়তানের আশ্রয়ে চলে যায়। আসলে অহংকার প্রদর্শনের পর থেকে শয়তান সূচনাকালেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে, আমি এই অহংকারীকে বক্রতার পথে নিয়ে যাব, আর এতে শয়তান জোর প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে আর মানুষকে আল্লাহর বান্দায় পরিণত হতে বাধা দিতে থাকে।

শয়তান ভাবে এই অহংকারীকে আমি বিভিন্ন পদ্ধতিতে এমনভাবে ফাঁসাবো যে, মানুষ যদি সৎকর্ম সম্পাদন করতেও পারে তবুও নিজ প্রকৃতিগত অহংকারের কারণে আত্মম্ভরিতা তাকে ধীরে ধীরে ঔদ্ধত্য করে তুলে। এই ঔদ্ধত্য শেষ পর্যন্ত তাকে তার ছোট ছোট সৎকর্মের পুণ্য থেকে বঞ্চিত করে দেয়।

কেননা শয়তান প্রথম থেকেই এই সিদ্ধান্ত করে নিয়েছিল, সে মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করবে আর সে নিজেই তো অহংকারের কারণে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ অমান্য করেছিল। এজন্য এটাই সেই যুদ্ধ, যা শয়তান অমূলক বিভিন্ন বাহানায় মানুষের ওপর চেপে বসে তাকে পরীক্ষায় ফেলে।

তবে রহমান ও দয়ালু খোদার বান্দা যারা আল্লাহতায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ প্রাপ্ত বান্দা, তারা কখনো কোনো ক্ষমতা বা অর্থ সম্পদের অধিকারী হলে তারা অহংকার না করে সৃষ্টির সেবায় আরো অধিকহারে নিজেকে নিয়োজিত করে। তারা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইবাদতে একনিষ্ঠ হয় আর শয়তানের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে চলে।

অহংকার এমন একটি রোগ যা একবার কারো ঘাড়ে চেপে বসলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক কষ্টকর। এটি এমন এক মারাত্মক মানসিক ও চারিত্রিক রোগ, যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘আর পৃথিবীতে দম্ভভরে চলো না। কেননা তুমি কখনো পৃথিবীকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতার পর্বতসমও হতে পারবে না।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৭)

এ আয়াত থেকে যেভাবে সুস্পষ্ট হয় মানুষের তো কোনোই মর্যাদা নাই, তাহলে মানুষের মাঝে কীসের এত অহংকার।

হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত যাবের (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেন, কেয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় আর সবচেয়ে আমার নৈকট্য লাভ করবে তোমাদের মধ্যেকার সেই লোকেরা যারা সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবে। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে শাস্তিপ্রাপ্ত আর আমার থেকে সবচেয়ে দূরে থাকবে সেই সব ‘ছরছার’ লোকেরা অর্থাৎ যারা কথা বানিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে ‘মুতাসাদ্দিক’ অর্থাৎ বড়াই করে মুখ ফুলিয়ে কথাবার্তা বলে আর ‘মুতাফাইহিক’ অর্থাৎ মানুষের ওপর ঔদ্ধত্য ফলায়। সাহাবিগণ (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রসুল (সা.)! ছরছার আর মুতাসাদ্দিক-এর অর্থ তো আমরা জানি তবে মুতফাইহিক কারা? তিনি (সা.) জবাবে বললেন, মুতাফাইহিক হলো তারা, যারা আত্মম্ভরিতা, অহংকার ও ঔদ্ধত্যের সাথে কথা বলে।’ (সুনানে তিরমিজি)

অপর এক হাদিসে রয়েছে হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক পাপের মূলে রয়েছে ৩টি বিষয় তা থেকে আত্মরক্ষা করা উচিত, প্রথমত ঔদ্ধত্য থেকে বাঁচো, কেননা ঔদ্ধত্যই শয়তানকে প্ররোচিত করেছে, যেন সে আদমকে সেজদা না করে দ্বিতীয়ত লোভ সংবরণ করো কেননা এই লোভই আদম (আ.)কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে উসকিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত ঈর্ষা থেকে বাঁচো কেননা এই ঈর্ষার কারণেই আদমের দুই পুত্রের মধ্য থেকে একজন নিজের ভাইকে হত্যা করেছে। (আর রিসালাহ, বাব আল হামাদি, পৃষ্ঠা : ৭৯)

আরও একটি হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম ও জান্নাতের পরস্পরের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা হবে। জাহান্নাম বলবে, আমার ভেতর ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অহংকারী লোকেরা প্রবেশ করবে আর জান্নাত বলতে শুরু করবে, আমার মাঝে দুর্বল আর গরিবেরা প্রবেশ করবে। এতে আল্লাহতায়ালা জাহান্নামকে বলেন, তুমি আমার শাস্তির প্রকাশকারী, যাকে আমি চাই তোমার মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে থাকি এবং জান্নাতকে তিনি (আল্লাহ) বললেন, তুমি আমার কৃপার বিকাশস্থল, আমি যাকে চাই তোমার মাধ্যমে কৃপাবর্ষণ করি। আর তোমাদের যা প্রাপ্য তোমরা উভয়ই তা পুরোপুরি পাবে।’ (সহি মুসলিম)

আল্লাহ করুন, আমরা সবাই যেন বিনয়, নম্রতা আর সৎব্যবহারের উত্তম পথে চলে আল্লাহতায়ালার কৃপাদৃষ্টি লাভকারী হই, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।