মহানায়কের ফেরার দিন

এমএম নাজমুল হাসান
এমএম নাজমুল হাসান এমএম নাজমুল হাসান , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ১০ জানুয়ারি ২০২৩

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশ হলো একমাত্র জাতি রাষ্ট্র যা কোনো ব্যক্তির নামেই সারাবিশ্বে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ থেকে ৫১ বছর আগে এইদিনে জাতির অবিসংবাদিত নেতা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে পাকিস্তানের কারাগারের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফেরেন। তাঁর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাঙালি পায় বিজয়ের পূর্ণতা। ঐতিহাসিক দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে অগ্রগণ্য, যা বাঙালি জাতির জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক ইতিহাসের অনন্য মাইলফলক।

ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে '৪৭ দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পরাধীনতার যাঁতাকালে নিক্ষিপ্ত হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হওয়া পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ)। বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আপামর জনগণ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। এর ১৮ দিন পর অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী, যা ইতিহাসের কালরাত হিসেবে পরিগণিত। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাক সেনারা। গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের জনগণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে বিমানে প্রথমে রাওয়ালপিন্ডি নেওয়া হয়। এরপর লাহোর থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে লায়ালপুর শহরের মিয়ানওয়ালি কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে রাখা হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে। মুক্তির আগ পর্যন্ত লায়ালপুর ও শাহিনওয়ালের দুটি কারাগারে কাটাতে হয় জাতির এই অবিসংবাদিত নেতাকে।

কারাগারে আটক রেখে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে বিচার শুরু করে পাকিস্তান সামরিক সরকার। অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’করা। ১২টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টির রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড। টাইমসের প্রতিবেদনে লেখা হয় এই বিচার শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর। এদিকে পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সেনা কর্মকর্তাদের রাওয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠিয়ে শেখ মুজিবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

৭ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালিতে ফিরিয়ে আনা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এদিন জেলখানার দায়িত্বরতদের জানানো হয় নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) বাঙালিরা হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হবে। ১৬ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় জেল সুপার বঙ্গবন্ধুর সেলের দরজা খুলে ঢুকলে তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না জানতে চান। কারণ তিনি আগেই দেখেছিলেন তাঁর সেলের বাইরে কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে।

জেল সুপার বলেন, তাঁকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু তাকে আবার বললেন, যদি ফাঁসিই দেওয়া হয় তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন। তিনি না না বলে একদম সময় নেই জানিয়ে দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে কয়েক মাইল দূরে অজ্ঞাত স্থানে নয়দিন সরিয়ে রাখেন। জেলের কর্মকর্তারা জেল সুপারকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছু জানেন না বলে জানান।

১৯ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণের কথা জেল সুপারকে জানান এক পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি শেখ মুজিবকে আর লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে বলেন, তাঁর সাথে কথা বলতে চান ভুট্টো। তারপর রাওয়ালপিন্ডিতে শেখ মুজিবকে নিয়ে গৃহবন্দি করা হয় এবং ২৪ ডিসেম্বর তাঁর সাথে দেখা করেন ভুট্টো।

তৎকালীন নিউইয়র্ক টাইমসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সিডনি শ্যানবার্গ বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ভুট্টোর মনে হয়েছিল, শেখ মুজিবকে হত্যা করলে হয়তো বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করা হবে। একপর্যায়ে ভুট্টো তাঁকে (শেখ মুজিব) দুই প্রদেশের মধ্যে কোন রকম সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অনুরোধ করেন।

শেষবারের মতো ৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন ভুট্টো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার জন্য ৬৭ দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

অবশেষে বিশ্ব জনমতের চাপে নতি স্বীকার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের মানচিত্র খচিত হলেও মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে, যা গ্রেগরিয়ান হিসাব মতে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি।

বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর প্রথমেই তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশে আসেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সেটাই সম্ভব ছিল না, কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার করা। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরান অথবা তুরস্ককে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধু সে প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর লন্ডনে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পাকিস্তান সরকার প্রকাশ করেনি। তিনি চেয়েছিলেন, নিজেই বিশ্বকে তাঁর মুক্তির বার্তা দিতে।

এরপর বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে একটি সামরিক বিমানে তুলে দেয় পাকিস্তানি সরকার। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ৬টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমান অবতরণের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছলে ব্রিটিশ বৈদেশিক শাখার উপস্থিত কর্মকর্তারা স্বাগত জানান। এর কিছুক্ষণ পরে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি জানান।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত সংবাদে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ সেদিন সকালে বিবিসি মর্নিং সার্ভিসে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে লন্ডনে আসছেন এমন খবর পরিবেশন করা হয়। একইদিন রয়টার্স শিরোনাম করেছিল ‘লন্ডনে শেখ মুজিব।’

বঙ্গবন্ধুকে সকাল ৮টার মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেওয়ায় লন্ডনের ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন (পরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হোটেল ক্যারিজেসে যান। লন্ডনে পৌঁছে সকাল ১০টার পর তিনি কথা বলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। এছাড়া তিনি টেলিফোনে কথা বলেন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও।

বাঙালির মহানায়ক যখন লন্ডনে পৌঁছান তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। তিনি পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে চলে আসেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ৮ তারিখ বিকেল ৫টায় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যে বৈঠকে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়টি উল্লেখ করেন শেখ মুজিব।

বৈঠকের আগে বঙ্গবন্ধু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এসে গাড়ির দরজা খুলে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু মাত্র একদিন যাত্রাবিরতি করেছিলেন। ৯ জানুয়ারি সানডে টাইমস ‘ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠক’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে আসার প্রায় একমাস পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন।

এরপর ৯ জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ কমোট বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হিথ্রো বিমানবন্দর ছাড়ার পর বিবিসি ঘোষণা দেয় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন শেখ মুজিব। কিন্তু সেদিন সকালে লন্ডনে থাকা অবস্থায় টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধী এবং ঢাকায় ফেরার পথে দিল্লিতে যাত্রাবিরতির অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ কমোট বিমানে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

দিল্লির ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে ‘কালো-ধূসর ওভারকোট’ পরে বঙ্গবন্ধু বিমানের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভা, তিনবাহিনীর প্রধানসহ অন্যান্য অতিথি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন। বঙ্গবন্ধুকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে অভিনন্দন ও তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের মাধ্যমে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেই প্রত্যুষে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ, সরকার ও ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। তাছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়ার কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। ইন্দিরা গান্ধী তখনই জানিয়ে দেন, ‘যখনই বলা হবে, ভারতীয় বাহিনী তখন ফেরত যাবে।’ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ সফরের আগেই ভারতীয় বাহিনী নিজ দেশে ফিরে যায়।

দিল্লিতে জনসভার পর একইদিন ১০ জানুয়ারি স্বদেশের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ রুপালি কমোট বিমানে রওয়ানা দেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বিজয়ের বেশে বিজিত জাতির সামনে মাথা উঁচু করে স্বপ্নের সোনার বাংলায় পা রাখেন জাতির মহানায়ক। বিমান থেকে নামার আগেই বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ব্রিটিশ কমোট বিমানের পাইলটরা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ঢাকার আকাশে চক্কর দেন।

বঙ্গবন্ধু ঢাকার আকাশ থেকে প্রাণভরে অবলোকন করেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা। বিমান থেকে নেমেই আবেগে কেঁদে ফেলেন বাঙালির অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব। তৎকালীন প্রকাশিত পত্রিকা থেকে জানা যায়, ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য ঢাকার রাস্তায় ঢল নামে। জাতির মহানায়ককে বরণ করে নিতে সেদিন তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত ছিল জনসমুদ্র। বিমানবন্দর থেকে খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছান জাতির মহাপুরুষ শেখ মুজিব।

স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও স্বজনদের কাছে না গিয়ে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে জনগণের কাছে চলে যান। এরপর সেখানে বিকেল ৫টায় সদ্য স্বাধীন দেশের প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাষণ দেন শেখ মুজিব। প্রায় কুড়ি মিনিটের সেই আবেগতাড়িত বক্তৃতায় পাকিস্তানে বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বলেন, তিনি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন, বাঙালিকে কেউ ‘দাবায় রাখতে’ পারবে না।

বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার কথা বলেন। যার ভিত্তি হিসেবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। রাজনীতির কবি শেখ মুজিব ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতা পায় স্বাধীনতা। তাঁর আগমনে প্রশমিত হয় সন্তানহারা মায়ের ক্রন্দন, সম্ভ্রমহারা বোনের আর্তনাদ, পিতা-মাতাহারা সন্তানের প্রলাপ। বাঙালি খুঁজে পায় তার মহানায়ককে। জাতি পায় স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।