শীত বারবিকিউ পার্টি ও করিমন বেওয়া

শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২৩

আজকাল ঢাকার সুপার শপগুলোতে একটা বস্তু খুব চোখে পড়ছে। সেটা হলো বারবিকিউর সরঞ্জাম। ছোট এক ব্যাগ কয়লা, সঙ্গে বারবিকিউ করার বিশেষ চুলা, শিক, ব্রাশ, বারবিকিউ অয়েল ইত্যাদি।

এই বস্তুটি এত বেশি থাকার কারণ নিশ্চয়ই চাহিদা আছে এর। তা চাহিদা তো থাকবেই। হাজার হোক শীত তো পার্টির মৌসুম। উৎসবের মৌসুম। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকেও প্রায়ই বারবিকিউ পার্টির দাওয়াত পাই। তারা অবশ্য আমার মতো গরিব মানুষকে দাওয়াত দিতে খুব উৎসাহ পায় না, তবে নেহাত ভদ্রতার বশে পুরোনো পরিচিত বন্ধু বলেই দেয়। আমি যাবো না জেনেই দাওয়াত দেয় হয়তো।

শীতের ফ্যাশনও চলছে বেশ। বাঙালি হলো শীত সোহাগী। কারণ শীত থাকে মেরে কেটে মাত্র দুই মাস। সেই দুই মাসের জন্য বাঙালির ফ্যাশনের আর কেনাকাটার শেষ নেই। নিত্যনতুন শাল, সোয়েটার, ভেলভেটের কোট, ওভারকোট, পাঞ্চো, ব্লেজার, স্যুট, জ্যাকেট কতকিছু।

ঢাকার শপিংমলগুলোতে যে পরিমাণ শীতের পোশাকের স্তূপ দেখছি তাতে ষোল কোটি বাঙালির বত্রিশ কোটি কাপড় হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারপরও রংপুরে, কুড়িগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা এবং আরও অনেক স্থানে শীতের রাতগুলোতে অবর্ণনীয় কষ্ট করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো করিমন বেওয়ার কথা। আমরাই পারি নামে একটি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের আমি সদস্য অনেক বছর ধরে। সেই সূত্রে বেশ কয়েক বছর আগে নীলফামারী গিয়েছিলাম। সেখানে এক প্রবীণ নারীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সেসময় তার বয়স ছিল পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন। কিন্তু দেখতে মনে হতো সত্তর। অপুষ্টি, অবহেলা আর কঠোর শ্রম তাকে অকালে বৃদ্ধ করে দিয়েছিল।

করিমন বেওয়া জানিয়েছিলেন, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হন তিনি। চার ছেলে ও দুই মেয়েকে ছোট রেখে মারা যান তার দিনমজুর স্বামী। এরপর অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদেরও। এখন তার এক মেয়ে মৃত আরেক মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে তার কাছেই থাকে।

চার ছেলের একজনও মা-বোনকে ভাত কাপড় দিতে চায় না। এমনকি ভিটেবাড়ি থেকে বের করে দিতে না পারলেও ঘরের ভেতরে থাকতে দেয় না। ছেলের বউরা শাশুড়ি ও ননদকে বারান্দায় বের করে দিয়েছে। ছেলেরা নিজেরাও দরিদ্র। তারাও দিনমজুরি করে। তাদের নিজেদের বউ ছেলেমেয়ে পালতেই হিমশিম। সেখানে মা-বোনকে তারা ফালতু মনে করে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।

গরমকালটা কোনোমতে কাটলেও শীত এবং বর্ষায় অবস্থা খুব খারাপ হয়ে দাঁড়ায় মা-মেয়ের। মেয়ে কোনো না কোনো কাজ করে মায়ের ও নিজের ভাতটা জোটাতে পারে। কিন্তু ঘর তোলার সামর্থ্য তার নেই। ওই বারান্দায়ই কোনোমতে ছেঁড়া কাঁথা কাপড় দিয়ে আর বাঁশের চাটাই দিয়ে কিছুটা ঢেকে মাথা গোঁজার আশ্রয় করে নিয়েছেন তারা।

এবারের শীতটা খুব জাঁকিয়েই পড়েছে। সেই শীতে বারবিকিউ পার্টির দাওয়াত পেয়ে কেন জানি মনে পড়লো করিমন বেওয়ার কথা। সে কি বেঁচে আছে? জানি না। নববর্ষের প্রথম প্রহরে মানে থার্টি ফার্স্ট নাইটে এবার ঢাকায় আতশবাজির ঝলকানি দেখেছেন নিশ্চয়ই। এই আতশবাজির খেলা দেখে আমার মনেই পড়েনি যে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া।

মনে পড়েনি যে আমরা রিজার্ভ সংকটে ভুগছি। কখন দেশটা ‘শ্রীলঙ্কা’ হয়ে যায় এই ভয় এক মাস আগেও আমাদের তাড়া করেছে। কিন্তু আতশবাজির খেলা দেখে এসব কথা মন থেকে উড়ে গেছে। আমরা শুধু মুগ্ধ হয়ে খেলা দেখেছি। আগুনের খেলা। কত অর্থ এই রঙিন আলো জ্বালাতে গিয়ে পুড়লো সে হিসাব করিনি।

যে আতশবাজি ঢাকা শহরে জ্বলেছে, সেই টাকা দিয়ে ঢাকার প্রতিটি ছিন্নমূল শিশু এবং প্রবীণদের গায়ে গরম কাপড় জুটতে পারতো। আমার কখনও মনে হয় না আমরা দরিদ্র দেশ। আমাদের সম্পদের কোনো অভাব নেই। সম্পদের অভাব থাকলে এত বারবিকিউ পার্টি, এত আতশবাজির রোশনাই থাকার কথা নয়। গলদ হলো আমাদের বণ্টন ব্যবস্থায়।

টাকা আছে, সম্পদ আছে। কিন্তু সেটা রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মুঠোর ভেতরে। আর সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে, বেগমপাড়ায়, দুবাইয়ের ভিলায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে। দরকার হলো সুষম বণ্টন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বেশ কিছু উন্নয়ন মডেল পড়তে হয়েছিল। সেটা কেবল পরীক্ষা পাসেই কাজে লেগেছে। কিন্তু মাথার ভেতর থেকে তো আর বিষয়গুলো বের করে দিতে পারিনি। বাংলাদেশের উন্নয়নটা অবকাঠামোগতভাবে না হয়ে, হওয়া দরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে। তাদের কর্মসংস্থান, তাদের জন্য উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

ওপর থেকে নিচে নয়, দরকার নিচ থেকে মানে তৃণমূল পর্যায় থেকে উপরের দিকে উন্নয়নের গতি নির্ধারণ করা। সব দেশের রক্ত চুষে ঢাকায় আলো জ্বালিয়ে লাভ নেই। দরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়ন। গ্রামে যদি মানুষের নিরাপত্তা, কাজের সুযোগ, শিক্ষার সুযোগ, চিকিৎসার সুযোগ থাকে তাহলে তো ঢাকায় এসে ভিড় জমানোরও দরকার নেই।

তৃণমূল পর্যায় থেকে দারিদ্র্য বিমোচন না করতে পারলে ঢাকার বহুতল ভবনের রোশনাই সেই অন্ধকার ঢাকতে পারবে না। করিমন বেওয়ারা যতদিন শীতে কাতর হয়ে রাত কাটাবেন, ততো দিন ঢাকার শপিংমলের ফ্যাশনেবল শীতের পোশাকও আমাদের নগ্নতা ঢাকতে পারবে না।

সম্পদের সুষম বণ্টন এখন সময়ের দাবি।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস

তৃণমূল পর্যায় থেকে দারিদ্র্য বিমোচন না করতে পারলে ঢাকার বহুতল ভবনের রোশনাই সেই অন্ধকার ঢাকতে পারবে না। করিমন বেওয়ারা যতদিন শীতে কাতর হয়ে রাত কাটাবেন, ততো দিন ঢাকার শপিংমলের ফ্যাশনেবল শীতের পোশাকও আমাদের নগ্নতা ঢাকতে পারবে না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।