বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা খাটো করা যাবে না
![বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা খাটো করা যাবে না](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/mmm-20230328094714.jpg)
মাত্র দুইদিন আগে স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকী পালন করা হলো। দুঃখের বিষয়, এত বছর পরেও আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবারও এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জিয়াউর রহমানের ঘোষণাতেই নাকি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয় ২৬ মার্চ। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তার কণ্ঠে এই ঘোষণা উচ্চারিত হওয়ার একটি তাৎপর্যও রয়েছে, তারপরও তার ঘোষণায় দেশ স্বাধীন হয়েছে এমন অবান্তর বক্তব্য যখন দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের মুখে উচ্চারিত হয়, তখন দুঃখই লাগে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা বেতারে প্রচারিত হয়েছিল ২৭ মার্চ। যদি জিয়াউর রহমানকেই স্বাধীনতার ঘোষক বলে মনে করা হয়, তাহলে ২৬ মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়?
এটা নিয়ে বিতর্ক থাকা উচিত নয় যে, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসম সাহসী ও বাস্তববাদী একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি পরাধীন বাঙালিকে মুক্তি দিতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার মতো নেতা শুধু হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র আছেন। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তারাই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে ইতিহাসকেও জবরদখল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এটা মোটেও অতিকথন নয় যে, শেখ মুজিবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ হয়তো স্বাধীন হতো না।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ জন্য ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ এক ভাষণে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘This time Mujib will not go unpunished.’ তিনি বলেছিলেন শেখ মুজিবকে তিনি শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না এবং হুংকার দিয়েছিলেন এক ইঞ্চি ভূমিও ছেড়ে দেওয়া হবে না। জিয়াই যদি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন, তাহলে ইয়াহিয়া কেন জিয়ার নাম উল্লেখ না করে শেখ মুজিবকেই টার্গেট করলেন?
পাকিস্তানি জেনারেলদের বড় রকমের দুশ্চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তাকে বন্দি করতে পারা যাবে কিনা, করা গেলে কোথায় কীভাবে তাকে রাখা হবে, এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। বন্দি করার কাজটা যখন সম্পন্ন হলো তখন টিক্কা খান এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, ভেবেছিলেন বাঙালির বন্দি নেতাকে ঢাকাতেই রাখবেন এবং প্রকাশ্যেই বিচার করবেন।
তবে যারা কিছুটা কম হিংস্র ও অধিক বাস্তববাদী ছিলেন তারা স্বস্তি পেয়েছিলেন তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে পেরে। কিন্তু ইয়াহিয়া তাকে নিয়ে কী করবেন সে প্রশ্ন ইয়াহিয়ার নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ছিল মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছার। কিন্তু মুজিবকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর সেটা আর সম্ভব ছিল না।
ওদিকে সেনাবাহিনী আশা করছিল তার বিচার করা হবে। তাই বিচারের ঘোষণা তাকে দিতে হয়েছিল এবং আয়োজনও করা হয়েছিল। তবে ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী জি ডব্লিউ চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে হাসান জহির লিখেছেন, বিচারের ব্যাপারে ইয়াহিয়া যে স্থির সংকল্প ছিলেন তা নয়। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের প্রতিক্রিয়াটি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
বিচার শুরু হয় ১১ আগস্ট, শেষ হয় ১ ডিসেম্বর। সর্বসম্মত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেওয়া হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে; জেলখানার পাশে কবরও খনন করা হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে ইয়াহিয়া গং পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই কবর খনন করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করার বিষয়টি তখন অবান্তর হয়ে পড়েছিল।
তদপুরি আমেরিকানরা নাকি দাবি করেছিল এবং সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিল যে, মুজিবের বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়ন করা হবে না। এর মধ্যে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সব হুংকার বাঙালি ভণ্ডুল করে দেয়। পাকিস্তানিরা শুধু এক ইঞ্চি ভূমি নয় পুরো বাংলাদেশকেই মুজিবের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়ে যখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসার যোগ্যতা অর্জন করলেন তখন পাকিস্তানি শাসক-শোষকরা বাঙালি এই নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, ২৫ মার্চ কালরাতে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সব দোষ চাপানো হয় বঙ্গবন্ধুর ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক শাসকদের চোখে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেভাবে স্বাধিকারের বিষয়টি বাঙালি জাতির সামনে পরিষ্কার করে তোলেন আর কোনো নেতার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি।
শেখ মুজিব জানতেন পাকিস্তানিরা কোনোদিনই বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভার দেবে না। এ কথা এখন পাকিস্তানিদের লেখা বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকেও জানা যাচ্ছে। সিদ্দিক সালিক নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানি চক্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করেছেন তার ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অফিসার। ঢাকায় পা দিয়েই তিনি শোনেন ইয়াহিয়া খান বাঙালিকে ‘বেজন্মা (বাস্টার্ড)’ বলে গালাগাল করছেন। এমনকি ইয়াহিয়া খান নিজের লোকদের শুনিয়ে শুনিয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাস্টার্ড’ বলেছিলেন।
ইয়াহিয়া খান যখন পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সংলাপরত সেই সময়ও ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গীদের আশ্বস্ত করতেন এই বলে যে, ‘ব্লাক বাস্টার্ডদের’ ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। সিদ্দিক সালিক নিজ কানে এসব কথা শুনেছেন বলে তার বইতে উল্লেখ করেছেন। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের ভরসা ছিল চীন ও আমেরিকার ওপর। তারা ভেবেছিল চীন ভারতকে ঠেকিয়ে রাখবে আর আমেরিকা ঠেকাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে।
শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে ঠিকই, তবে সেই স্বাধীনতার জন্য তার জীবন বিপন্ন হবে। তাকে জীবনও নিতে হতে পারে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’ নামে একটি বই লিখেছেন । সেই বইতে তিনি উল্লেখ করেন ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যখন প্রহসনের সংলাপ চলছিল, তখন ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রেসিডেন্ট ভবনেই দেখা হয়েছিল।
শেখ মুজিব ভুট্টোকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাকি তখন নাটকীয়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব তবু ইতিহাসের হাতে মরবো না।’ পরবর্তী সময়ে আমরা শেখ মুজিবের অনুমানই সত্য হতে দেখেছি। ভুট্টো সেনাবাহিনীর হাতে মারা পড়লেন ঠিকই।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিপীড়িত বাঙালির কণ্ঠস্বর, তার বজ্রকণ্ঠের ভেতর দিয়েই প্রকাশ পেত বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা, বিক্ষোভ। এজন্য পাকিস্তানিদের চোখে এবং পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসরদের চোখে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন এক নম্বর শত্রু। হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায় আরেক তথ্য, ওই রিপোর্ট শেখ মুজিবকে কোর্ট মার্শাল করা দরকার বলে জানায়। কিন্তু তার কোর্ট মার্শাল হলো না। কারণ ক্ষমতায় এসে ভুট্টো নানা ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তাছাড়া ভারতে আটক ৯০ হাজার সৈনিক ফেরত আনা, বাংলাদেশ যে ১৯৫ জনকে বিশেষ করে চিহ্নিত করে বিচারের জন্য তাদেরকে রক্ষা করা- এসব করতে করতে ভুট্টো আর শেখ মুজিবকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে পারেননি। তাছাড়া এটাও অস্বীকারের উপায় নেই তখন শেখ মুজিবের বিচার করতে গেলে ভুট্টো আর ইয়াহিয়া খানকেও চরম মূল্য দিতে হতো।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেভাবে একা মোকাবিলা করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে বাঙালি জাতি যেভাবে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে- এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সব ধরনের উস্কানির মুখে হটকারিরা পরিহার করে বঙ্গবন্ধু যেভাবে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন তা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই পরিচয় বহন করে।
আজ অনেকেই বলেন, মুজিব যখন বুঝতেই পেরেছিলেন সংলাপে কিছু হবে না, তাহলে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর ছিল বিমান বাহিনী ও হেলিকপ্টার তৈরি ছিল লাখ লাখ জনতার ওপর আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন তার বক্তব্যে- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
তখন স্বাধীনতা ডাকের আর বাকি রইল কি? এই প্রশ্নেরও উত্তর আছে সিদ্দিক সালিকের বইতে। সিদ্দিক সালিক তার বইতে লিখেছেন, ‘২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর সঙ্গে নাকি বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণা শোনা গিয়েছিল।’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনেক পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। পাকিস্তানিরা আক্রমণ করলে কী করতে হবে তা বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন।
আজ স্বাধীন বাংলার আকাশে যে বিজয় পতাকা পতপত করে ওড়ে সেই পতাকার রঙের সঙ্গে লেগে আছে লাখ লাখ শহীদদের রক্তে দাগ। শিশু-নারী-যুবক-বৃদ্ধদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, পতাকা। সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে যারা পাকিস্তানিদের সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের সুযোগ দেয়, তারাই বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা খাটো করার জন্য মনগড়া তথ্য প্রচার করে। তবে এরা কখনই সফল হবে না। বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার চেষ্টা যারা করবে, তাদের ঠাঁই হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। শেখ মুজিব ইতিহাসের স্রষ্টা, তাকে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া যাবে না।
২৭ মার্চ, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/জিকেএস