চোখের বালির বিনোদিনী থেকে আজকের রাইমা
ঋতুপর্ণা ঘোষের ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনী চরিত্রে রাইমা সেনের অনবদ্য উপস্থিতি যেন বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন এক সূচনা ঘোষণা করেছিল। সুচিত্রা সেনের নাতনি, মুনমুন সেনের কন্যা হয়েও তিনি নিজের পরিচয়ের আলাদা রেখা টেনে নেন সেই চরিত্রের মধ্য দিয়ে। সংযত চোখের ভাষা, দৃঢ় অভিব্যক্তি আর অভিনয়ের ভেতরকার নীরব শক্তি সব মিলিয়ে রাইমা হয়ে ওঠেন ভিন্ন ধারার প্রতীক। সময়ের পরত পেরিয়ে আজও সেই রাইমা বদলেছেন, কিন্তু হারাননি নিজের মাধুর্য, সংযম আর গভীরতা। এখন তিনি শুধু একজন অভিনেত্রী নন এক পরিণত নারী, যিনি জানেন আলো-ছায়ার মাঝেই লুকিয়ে থাকে জীবনের আসল রঙ। ছবি: অভিনেত্রীর ইনস্টাগ্রাম থেকে
-
আজ এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। রাইমার জন্ম কলকাতার এক কিংবদন্তি পরিবারে। তার দিদিমা সুচিত্রা সেন যিনি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক অবিনশ্বর নাম। মা মুনমুন সেনও ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাই জন্ম থেকেই আলো, ক্যামেরা আর শিল্পের আবেশে বড় হয়েছেন রাইমা। কিন্তু তিনি কখনোই পারিবারিক পরিচয়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখেননি। বরং নিজের মতো করে অভিনয়কে দেখেছেন, বুঝেছেন এবং ধীরে ধীরে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছেন।
-
রাইমার অভিনয়ের সূচনা ঘটে ঋতুপর্ণা ঘোষের চলচ্চিত্র চোকের বালি দিয়ে, যেখানে ঐতিহাসিক সাহিত্যচরিত্রের আধুনিক ব্যাখ্যায় তিনি এনে দেন এক নতুন কোমলতা। তার সংলাপ, চোখের ভাষা আর সংযত অভিনয় সেই সময় থেকেই তাকে আলাদা করে তোলে। তিনি প্রমাণ করেন, নায়িকা মানেই শুধু গ্ল্যামার নয়, অভিনয়ও হতে পারে এক ধরনের নীরব কবিতা।
-
রাইমা কখনো বলিউডের চকচকে রাস্তায় হাঁটেননি খুব বেশি। হয়তো ইচ্ছে করেই। বরং তিনি বেছে নিয়েছেন গল্পনির্ভর, মননশীল চলচ্চিত্রের পথ। হানিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড, পারসোনালস, দ্য বং কানেকশন, বাইশে শ্রাবণ-প্রতিটি সিনেমায় তিনি ছিলেন গল্পের ভেতরকার আত্মা। তার অভিনয়ে কখনো থাকে এক চঞ্চল সরলতা, কখনো এক রহস্যময় গভীরতা।
-
রাইমার অভিনয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার চোখ। সেখানে একধরনের নীরব ভাষা আছে যা সংলাপ ছাড়াই চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলে। পরিচালক ঋতুপর্ণা ঘোষ একবার বলেছিলেন, ‘রাইমার চোখে এমন এক গল্প থাকে, যেটা অনেক অভিনেতা ডায়লগে বলেও বলতে পারে না।’ এ কথাটাই তার শিল্পীসত্তার আসল পরিচয়।
-
মিডিয়ার উজ্জ্বল আলোর পেছনে তিনি এক ভীষণ সংযমী মানুষ। আজকের দিনে যেখানে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেকে তুলে ধরা হয়, সেখানে রাইমা অনেকটাই ব্যতিক্রম। তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে রেখেছেন নিজের মতো গোপন, শান্ত। এই গোপনীয়তাই তার এক ধরনের সৌন্দর্য-যা তাকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
-
ডিজিটাল যুগে এসে রাইমা যেন আরও মুক্ত হয়েছেন। হ্যালো, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার, রিফিউজ, রক্তরহস্য-ওয়েব সিরিজে তার অভিনয় প্রমাণ করেছে, তিনি সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে জানেন, কিন্তু নিজের শৈলী হারান না। তার অভিনয়ে এখন পরিণত নারীর জটিলতা, আত্মবিশ্বাস ও মাধুর্য একসঙ্গে মিশে যায়।
-
রাইমা কখনো শুধু অভিনেত্রী নন, তিনি এক মানসিক অবস্থার নাম। তিনি জানেন সব গল্পে আলো থাকে না; কখনো কখনো অন্ধকারও সুন্দর হতে পারে। তাই তার চরিত্রগুলোতে যেমন আলো ছায়া খেলা করে, তেমনি জীবনের ভেতরের নিঃসঙ্গতাও জায়গা পায়।
-
সুচিত্রা সেনের নাতনি হওয়া একদিকে যেমন আশীর্বাদ, অন্যদিকে এক বিশাল চাপও বটে। কিন্তু রাইমা নিজের পরিচয় গড়েছেন ভিন্ন পথে। তিনি কখনো ‘সেন পরিবারের উত্তরসূরি’ হিসেবে নয়, বরং ‘নিজস্ব পরিচয়ের অভিনেত্রী’ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। তার ভেতরের এই আত্মবিশ্বাসই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।
-
রাইমা সেন যেন বাংলা সিনেমার এক অপ্রকাশিত কবিতা। তিনি কখনো শব্দে নয়, নীরবতায় বলেন গল্প। তার জীবন শেখায় গ্ল্যামার নয়, আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সংযমে, চরিত্রে আর নিজের প্রতি সত্য থাকার মধ্যে।