হাইকোর্টে জরণ বিবির ৬ বছর
ডাকাতির মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছেলে ফরিদ মিয়া (৩০)কে জামিনে মুক্ত করতে সুপ্রিম কোর্ট বিভাগের হাইকোর্টের বারান্দা এবং আইনজীবীর কাছে ছয় বছর ধরে ধর্ণা দিচ্ছেন সিলেটের জরণ বিবি (৬৫)। নিজের এবং ছেলের সহায় সম্বল বিক্রি করে মামলার পেছনে খরচ করার পরও ছেলেকে মুক্ত করতে না পারেননি তিনি। সিলেট কারাগারে বন্দি রয়েছে ছেলে ফরিদ মিয়া। অন্যদিকে দুই সন্তান রেখে বাপের বাড়ি চলে গেছে পুত্রবধূ। দুই নাতিকে নিয়ে এখন জরণ বিবির জীবন চলে ঢাকায় ও সিলেটে ভিক্ষা করে।
ঢাকায় মামলার খোঁজ নিতে এসে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণেই ভিক্ষা করেন জরণ বিবি। আবার সিলেটে ফিরে সেখানেও ভিক্ষা করেন তিনি। ছেলের দুই সন্তানকেও মাঝে মাধ্যে নিয়ে আসেন সুপ্রিম কোর্টে। জরণ বিবির অভিযোগ, ছেলের সঙ্গে একই মামলায় অন্য দুজনের জামিন হলেও রহস্যজনক কারণে ছেলের (ফরিদ মিয়া) জামিনের ব্যবস্থা করেননি আইনজীবী। পরে মামলা পরিচালনার জন্য অন্য আইনজীবীর দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।
জানা যায়, একই মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামির হাইকোর্ট থেকে জামিন হলেও অজানা কারণে কারাগারেই বন্দি রয়েছে ফরিদ মিয়া। মামলাটি বর্তমানে নিয়মিত কোর্টে শুনানির তালিকায় থাকলেও সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে উপস্থিত করতে না পারায় মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না।
জরণ বিবির বর্তমান আইনজীবী বেলায়েত হোসেন জানান, মামলাটি বর্তমানে নিয়মিত কোর্টের কার্যতালিকায় প্রকাশ পেলেও সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে উপস্থিত করা যায়নি। মামলার নথি না পাওয়ায় বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট রেজিস্টার বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, “মহামান্য হাইকোর্টে বিভাগের ২৭ (এনেক্স) কোর্টের কার্যতালিকায় মামলা নং ৭৯২৩/২০১১ এর আসামি ফরিদ উদ্দিন এর জামিন শুনানির জন্য প্রায় ৫ মাস যাবৎ অপেক্ষমান। মামলাটি নিয়মিতভাবে প্রতি রোববার বেঞ্চের কার্যতালিকায় আসে কিন্তু সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে উপস্থাপন করতে পারছি না। এ জন্য মহামান্য হাইকোর্ট সেকশন সুপারকে আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার তাগাদা দেন। ফাইলটি রহস্যজনক উধাও হওয়ায় ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা একান্ত আবশ্যক নতুবা সমুহ ক্ষতির সম্ভাবনা।”
এদিকে গত বুধবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ডেপুটি রেজিস্টার ১১ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবী বেলায়েত হোসেন।
সম্প্রতি জরণ বিবি আইন, বিচার ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনে ‘ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তার ছেলের মামলার বিষয়টি তুলে ধরেন। এছাড়া বিভিন্ন আইন সহায়তা কেন্দ্রের সহায়তাও চেয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে মার্চ মাসে একটি ডাকাতির মামলায় সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার পুরাণসতপুর গ্রামের মৃত এখলাছ মিয়ার ছেলে ফরিদ মিয়া (৩০)কে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে এ মামলায় পুলিশ বিশ্বনাথ এলাকার উজির ও নাজির নামে আরো দুজনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। একই বছর ওই মামলায় সিলেট জেলার বিচারিক আদালত এই তিনজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেন।
রায়ের বিরুদ্ধে ফরিদের মা জরণ বিবি এবং উজির-নাজিরের আত্মীয় স্বজন আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটনের মাধ্যমে হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ শুনানি শেষে উজির-নাজিরকে জামিনে মুক্তি দিলেও ফরিদের জামিন আবেদন নাকচ করেন। জরণ বিবি ওই আইনজীবীর কাছে একাধিকবার যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন জরণ বিবি মামলায় ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। এর পর আইনজীবী বেলায়েত হোসেনের দ্বারস্থ হন তিনি।
সাজাপ্রাপ্ত ফরিদের মা জরণ বিবি জানায়, আপিল মামলায় উজির-নাজিরের জামিন হলেও তার ছেলে ফরিদের জামিন হয়নি। এ জন্য আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন দায়ী। ঘরের চালের টিন বিক্রি করে আইনজীবীকে টাকা দিয়েছি, কিন্তু ছেলের জামিন শুনানি করেননি তিনি। অন্য আইনজীবীর কাছে যেতে চাইলে মামলার নথিপত্র ফেরত দেননি। ছয় বছর যাবৎ আদালতের বারান্দায় আমি ছেলের জামিনের জন্য ঘুরছি।
জরণ বিবি আরো বলেন, ছেলের দুই সন্তান রেখে ফরিদের স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। দুই নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করে জীবন চালাচ্ছি। কেউ খাবার দিলে খাই, না হলে উপোস থাকি।
এ বিষয়ে আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন ফোনে বলেন, “ফরিদের জামিনের চেষ্টা করেছি, আদালত জামিন দেয়নি। আমি ওই মামলায় ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে ওই মামলাটি অ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন পরিচালনা করছেন।” -এর বেশি কথা বলতে রাজি হননি আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম।
তবে নতুন করে মামলার দ্বায়িত্ব গ্রহণকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন বলেন, “মামলাটির নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু যে কোনো মামলার মূল নথি পত্র আদালতের কাছে জমা থাকে। ওই নথি আদালত থেকে উঠিয়ে এখন নতুন করে (ফাইল প্রস্তুত) জামিন আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি জামিন আবেদন শুনানি হতে পারে। জামিন হবে কি না সেটা একমাত্র আদালেতের ইচ্ছা।”
এফএইচ/আরএস/আরআইপি