বিশ্ববাজারে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ ছাগল হতে পারে বাংলাদেশের ট্রেডমার্ক

রাকিব হাসান রাফি
রাকিব হাসান রাফি রাকিব হাসান রাফি , স্লোভেনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১২:২৫ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

মাংস খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশেষত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে মাংস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ছুটি কিংবা উৎসবের দিনগুলোতে একবেলা মাংসের কোনও পদ না হলে পুরো দিনটাকে একেবারে ফিকে মনে হয়।

বাংলাদেশ কিংবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যেখানেই যান না কেনও বাঙালির হেঁশেলে খাশির মাংস অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। আর খাশির মাংসের কথা আসলে সবার প্রথমে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের নাম উচ্চারিত হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হতে পারে অন্যতম সম্ভাবনাময়ী একটি নাম।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে এ বিশেষ প্রজাতির ছাগলটি হতে পারে এ দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম মোক্ষম হাতিয়ার।

কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের যার কারণে একে ঘিরে এত সম্ভাবনা? এ প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে প্রথমে একটু সংক্ষেপে বিশেষ প্রজাতির এ ছাগল সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

গ্রামাঞ্চলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে অনেক সময় কালো ছাগল নামেও অভিহিত করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাতে এ ছাগলের বিস্তৃতি রয়েছে। মূলত এ প্রজাতির ছাগলের গায়ের রং কালো হওয়ায় একে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে বাদামি, ধূসর এমনকি সাদা বর্ণের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলেরও অস্তিত্ব রয়েছে।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট এবং পিঠের দিকটা সমতল। এ জাতের ছাগলের শিং ছোট ও পা খাটো। পূর্ণ বয়স্ক একটি ছাগলের ওজন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কেজি হয়ে থাকে।

মাংস উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী ভারতের যমুনাপাড়ি ছাগল, আফ্রিকার মাসাই ছাগল এবং চীনা জাতের ছাগল বেশ পরিচিত। আকারে তুলনামূলকভাবে এ সকল ছাগল বড় হওয়ায় এদের থেকে মাংস পাওয়া যায় বেশি। এমনকি দুধ উৎপাদন ক্ষমতাও বেশি থাকে এ সকল ছাগলের। তারপরেও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বর্তমানে এ পৃথিবীতে ছাগলের সেরা ব্রিড হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

প্রথমত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু, এছাড়াও চামড়ার গুণগত মান বিবেচনায় এ প্রজাতির ছাগল সেরা। বিশ্ব বাজারে ইতোমধ্যে এ প্রজাতির ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্যান্য বেশিরভাগ প্রজাতির ছাগলের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাচ্চা জন্মের পরই মারা যায়।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র পাঁচ থেকে দশ শতাংশ। এ প্রজাতির মাদী ছাগল প্রতি বছর গড়ে দুইবার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবারে এক সাথে তিন থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। এ কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গলের জীবনচক্রে মোট বংশবৃদ্ধির হার অনেক বেশি।

বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, চা, চিংড়ি এবং পাটজাত দ্রব্য আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। রফতানি খাতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যদিও একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউরোপের বেশিরভাগ শপিং মলগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে নিউইয়র্কার, রিভার আইল্যান্ড, লেভিসসহ বেশিরভাগ বড় বড় চেইনশপগুলো কাপড়ের নিচে মেইড ইন বাংলাদেশ কথাটির উল্লেখ থাকে যা বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের মাঝে আলাদা গর্ববোধের সূচনা করে। ইউরোপের অনেক সাধারণ মানুষই বাংলাদেশকে চেনে এ দেশের তৈরি পোশাকের মাধ্যমে।

ইউরোপের সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় মাংস একটি গুরত্বপূর্ণ উপাদান। ইউরোপের বাজারে প্রাপ্ত মাংসের বড় অংশ আসে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউ জল্যান্ড ও তুরস্ক থেকে। সেখানে মোট চাহিদার শতকরা আশি ভাগ ছাগল ও ভেড়ার মাংসের যোগানদাতা হচ্ছে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে সব মিলিয়ে ৭০০ মিলিয়নের মতো ভেড়া ও ছাগল রয়েছে যাদের শতকরা পঁচাশি ভাগ বিভিন্ন খামারে প্রতিপালন করা হয়। ইউরোপে মাটন কিংবা ল্যাম্ব বলতে ছাগল কিংবা ভেড়ার মাংস দুইটিকে বোঝায়।

বিজ্ঞাপন

গরু কিংবা ভেড়ার মাংসে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি একটি প্রধান সমস্যা। তাই যাদের শরীরে উচ্চরক্তচাপ কিংবা কোলেস্টেরোলজনিত সমস্যা রয়েছে তারা গরুর মাংশ কিংবা ভেড়ার মাংস এড়িয়ে চলেন। এছাড়াও ভেড়ার মাংসে এক ধরনের উৎকট গন্ধ থাকে যার কারণে অনেকে ভেড়ার মাংস খুব বেশি একটা পছন্দ করেন না।

অন্যান্য রেড মিটের তুলনায় ছাগলের মাংসে ক্যালরি, সম্পৃক্ত চর্বি ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেকটাই কম থাকায় তেমন কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই থাকে না। পাশাপাশি সোডিয়ামের মাত্রা কম থাকায় এবং পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি হওয়ায় যারা একটু স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের কাছে ক্রমেই ছাগলের মাংস জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক জরিপ অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজারে প্রত্যেক বছর গড়ে ছাগলের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে শতকরা দেড় শতাংশ।

ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার সামাল দিতে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল হতে পারে অমিত সম্ভাবনাময়ী। অন্যান্য প্রজাতির ছাগলের মতো এ জাতের ছাগলের মাংসে তেমন কোনও কড়া গন্ধ পাওয়া যায় না, চর্বির পরিমাণ কম থাকায় লিন বানাতেও তেমন একটা অসুবিধা হয় না। স্বাদের দিক থেকেও এগিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগলের মাংস। চামড়ার গুণগত মানের জন্য এদেশের চামড়াশিল্পে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে এ ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যেক দেশের নিজস্ব কিছু ট্রেডমার্ক রয়েছে, একটি দেশের নামের সঙ্গে সঙ্গে এ সকল ট্রেডমার্ক সমানভাবে উচ্চারিত হয়। নির্দিষ্ট দেশ ছাড়া অন্য কোনও দেশ এ ট্রেডমার্ক ব্যবহার করতে পারে না। যেমন- কিউবার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে সিগারের নাম চলে আসে এবং কিউবার বাহিরে অন্যকোনও দেশ তাদের এ সিগার তৈরি করতে পারে না।

একইভাবে ইসরায়েলসহ সাথে রয়েছে জাফা নামক বিশেষ প্রজাতির কমলালেবু, তুরস্কের নামের সাথে রয়েছে মারাসের আইসক্রিম ইত্যাদি। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলকেও অনুরূপভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব ট্রেডমার্ক হিসেবে তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন থেকেই কাজ করা জরুরি। তাহলে বিশ্বব্যাপী আলাদাভাবে এ প্রজাতির ছাগলের পরিচিতি তৈরি হবে।

একই সাথে বাণিজ্যিকভাবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারে যাতে এ ছাগলের মাংস ও চামড়া রফতানি করার জন্য যথার্থ উদ্যোগ নেওয় হয় সে ব্যাপারে এখনই আমাদের সরকার ও খামারিদের কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সোনালি আঁশ কিংবা হোয়াইট গোল্ডখ্যাত চিংড়ি অথবা তৈরি পোশাকের মতো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলও হয়ে উঠতে পারে এদেশের ব্ল্যাক গোল্ড।

বিজ্ঞাপন

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com