সেই যুগ আর এই যুগ

বহু বছর আগের কথা। ইতিহাস হিসেবে রাখতে হলে ঘটনাকে সংরক্ষণ করতে হবে। তা নাহলে সব কথা, সব দেখা বা সব শোনার স্মৃতিচারণ হবে না বা তুলনা করা যাবে না। যেমন যদি আমরা এখন জানতে চাই অতীতে মানুষ কীভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন এবং এ যুগের মানুষ কীভাবে বিয়ে করছে ইত্যাদি। এটা একটি দিক, আরেকটি দিক অতীতে কে বা কারা এবং কী কারণে জেল হাজতে যেতো এবং এখন কারা সেখানে যায়, কেন যায় আর কী হয়?
এই দুটি বিষয়ের ওপর স্মৃতিচারণ করবো এবং সময়টি হবে আমার দেখা ১৯৬৮-২০২১ সময়কালের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে ভালো এবং মন্দের সমন্বয়ে। আমাদের স্বভাব চরিত্র থেকে শুরু করে সৃজনশীলতা, শালীনতারও বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে।
হবে সম্ভবত ১৯৬৮ সাল। আমার বড় মামা তখন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি। ছাত্র রাজনীতি করেন, বিরাট দাপট তার তখন। সে সময় যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মধ্যে লঞ্চ ছিলো জনপ্রিয়। সেবার লঞ্চযাত্রীর ভাড়া সামান্য বাড়ানো হয়েছে, কলেজের ছাত্ররা সুতা দিয়ে লঞ্চ নড়াইলের লঞ্চঘাটে বেঁধে রেখেছে দুইদিন। ভাড়া না কমালে লঞ্চ চলাচল বন্ধ।
তখনকার যুগে যোগাযোগের যে করুণ অবস্থা তারপর পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্র, সবমিলে ঘটনার মোড় স্বৈরাচারী পাক সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে পড়ে। শেষে মামাকে জেলে ঢোকানো হয়। তৎকালীন ছাত্রদের স্লোগান ছিল ‘জেলের তালা ভাঙবো জহির ভাইকে আনবো’। দীর্ঘ ২৮ দিন জেল হাজতে থাকার পর তাকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
জেল থেকে মুক্তি পেলে লাখো জনতা গলায় ফুলের মালা দিয়ে মামাকে বরণ করে, তৎকালীন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর জনতা। আমি তখন খুবই ছোট, তারপরও সেই স্মৃতি আজও মনে আছে। জনতার ভিড়ে নানা বাড়ির সেদিনের সেই দৃশ্য, নানির কান্নাহাসির মাঝে ছেলেকে বুকে ফিরে পাবার আনন্দ, সব কিছুতেই জড়িত ছিল স্বাধীনতা। কোনো এক সময় দস্যু রজক নামে এক বড় ডাকাত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, যার কথা বলে রাতের আঁধারে আমাদের ঘুম পাড়াতেন মুরব্বিরা।
আমরা যদি কখনও বিছানায় যেতে দেরি করেছি সঙ্গে সঙ্গে মুরব্বিরা বলতেন, ঘুমাও নইলে দস্যু রজব এসে ধরে নিয়ে যাবে ইত্যাদি। সে সময় কোনো ভালো লোক বা দেশপ্রেমিক জেলে ঢুকলে কাঁন্নার ঝরণা বইতো এবং দুষ্টু লোক জেলে ঢুকলে আনন্দ উল্লাসে জনতা ভাসতো। ইদানীং দেখছি শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতেও যেমন ধরুন কেউ জেলে ঢুকেছে মদ, গাঁজা সেবনে, দুর্নীতি বা খুন করার কারণে অথচ দেখা যাচ্ছে জেল হাজত থেকে বের হয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনন্দ ফুর্তির মধ্য দিয়ে ঘরে ফিরেছে!
আবার যারা দেশের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু বলছে বা লিখছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের জেল হাজতে ঢোকানো হচ্ছে এবং সেখানে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ধুকে ধুকে মরছে! কারো তাতে মাথাব্যথা নেই। আমাদের সময় ছড়ার বই ছিল, সেখানে আমরা পড়ছি যেমন ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।’
এখন জানি না ঠিক কোন ধরনের ছড়া নতুন প্রজন্ম পড়ে তবে শুনেছি এমনটি যেমন ‘পড়ালেখা করে যে, অনাহারে মরে সে। বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ, নাই মান। জানার নাহি শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’ ইত্যাদি। হতে পারে এটাই সে যুগ আর এ যুগের মধ্যেকার পার্থক্যের কারণ।
শুনেছি মার থেকে কীভাবে বাবার সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। ঘটকের মাধ্যমেই মুরব্বিদের মধ্যে আলোচনা পর্ব শেষে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য চোখে চোখ পড়েছিল মাত্র। বিয়ের পর পরিচয়, মন বিনিময়, সংসার, পরিবার, জীবন সব মিলে আশিটি বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন তারা সুখে-দুখে। আমার নিজের বিয়েরও একটি বর্ণনা রয়েছে, কখন, কীভাবে দেখা, পরিচয়, এবং পরিণয়।
আর এখন কী অবস্থা? সেটা কি লেখার প্রয়োজন আছে? এ যুগের সময়ের ওপর বাংলাদেশের জীবনের ব্যবস্থা নিয়ে মূলত লেখাটি শেষ করতে হঠাৎ টিভির পর্দায় ব্রিটিশ টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রাম নজর কেড়ে নিলো। কীভাবে এ যুগের ছেলে-মেয়েরা নিজ নিজ জীবন সাথী বেছে নিতে চেষ্টা করছে। টিভির পর্দায় যেহেতু প্রোগামটি দেখানো হচ্ছে এবং যা আমি সুইডেন থেকে দেখতে পাচ্ছি, ধরে নিতে পারি প্রযুক্তির যুগে ঘটনাটি বাংলাদেশের অনেকের নজর কেড়ে নিয়েছে।
মনে কি পড়ে ছোটবেলার কথা? দেখেছি মুরব্বিরা হাটে গরু কিনতে গেলে বেশ নেড়ে চেড়ে দেখতেন গরুকে, বিশেষ করে দাঁত দেখতেন। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এক মুরব্বিকে দাঁত দেখার কারণ? তিনি বলেছিলেন বয়স নির্ণয় করতে সুবিধা হয়। যাইহোক ব্রিটিশ টিভির পর্দায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ বা বিবস্ত্র অবস্থায় ছয়টি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে রয়েছে পাত্র হিসেবে একটি ছেলে যে পছন্দ করবে যেকোনো একজনকে।
ছেলেটি মেয়েদের টপ ট্যু বটম দেখছে, প্রশ্ন করছে, দেখছে প্রশ্ন করছে, যাচাই-বাছাই পর্ব শেষে দুটো মেয়েকে পছন্দ করছে। এবার এই দুটো মেয়ে ছেলেটিকে একইভাবে উলঙ্গ অবস্থায় যা কিছু দেখা এবং যা কিছু জানার জানছে। পরস্পর পরস্পরকে জানার পর সিদ্ধান্তে এসেছে তারা একে অপরকে জীবন সাথী করতে ইচ্ছুক এবং সেইভাবে মেলামেশার পর্ব শুরু। দীর্ঘ এক মাস পর তারা ফিরে আসছে টিভির পর্দায় এবং রিপোর্ট করছে আদৌ তারা একে অপরের সান্নিধ্য বা ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছে নাকি পরস্পর পরস্পরকে বর্জন করেছে?
বেশির ভাগই বিবাহ বন্ধনে ব্যর্থ হয়েছে। আমি নিজে থাকি সুইডেনে। সুইডেন স্বাভাবিকভাবে সব বিষয়ে ফ্রন্ট পেজেই থাকে। তবে ছেলে-মেয়ের বিবাহ বন্ধনের যাচাই-বাছাই পদ্ধতি তাদেরও অবাক করেছে। প্রোগ্রামটি প্রচার করা হচ্ছে যুক্তরাজ্য থেকে যেখানে বিশ্বের নানা জাতির বাস!
বিশ্ব কোনদিকে মোড় নিতে চলেছে বা কোন যুগ ভালো আর কোন যুগ মন্দ তার বিচার ভার সবার উপরই থাক, তবে প্রোগ্রামটি দেখার পর আমার রিফ্লেকশনে বার বার মনে হয়েছে ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়’ এবং ভাবনায় ঢুকেছে এসব ছেড়ে যদি আমরা এমনটি করে ভাবতে পারতাম আমরা মানুষ, আমাদের ক্ষমতা আছে মেশিন তৈরি করার, ক্ষমতা আছে জীবনকে সুখ ও শান্তিতে পূর্ণ করার, পরাধীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার, জীবনকে সুন্দর এবং দারুণভাবে অ্যাডভেঞ্চার করার।
এর সবকিছুই আমরা পেতে পারি একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তাহলে আসুন আমরা একটি নতুন ও শালীন বিশ্বের জন্য লড়াই করি, একটি শালীন বিশ্ব মানুষকে ভালো কাজ করার সুযোগ দেবে, যুবকদের ভবিষ্যত এবং বার্ধক্যকে নিরাপত্তা দেবে। এসবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাশবিকরা যুগে যুগে ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু তারা মিথ্যা!
তারা সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি, তারা কখনই করবে না! কারণ স্বৈরাচাররা নিজেদের স্বাধীন করে কিন্তু জনগণকে দাস করে! এবার আসুন অতীতের তিক্ততাকে ছেড়ে প্রতিশ্রুতি পূরণের লড়াই করি। আসুন আমরা বিশ্বকে মুক্ত করতে লড়াই করি-জাতীয় বাধা দূর করতে, লোভ ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা দূর করতে লড়াই করি। আসুন আমরা যুক্তির জগতের জন্য লড়াই করি, এমন একটি জগত যেখানে বিজ্ঞান তার সমস্ত অগ্রগতিকে সব শ্রেণির মানুষের সুখের দিকে পরিচালিত করবে!
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম