কণ্টকাকীর্ণ

ছেলের চেহারা একটু খারাপ হওয়া ভালো, বাড়িতে বউয়ের কদর থাকে

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ১০:৪৩ এএম, ২৭ অক্টোবর ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

পারিজাত রহমান উঠে গিয়ে ডাকলেন পরের ক্লায়েন্টকে।

নাবিলা হক...

বিজ্ঞাপন

নাবিলা হক উঠে দাঁড়ালো, পারিজাত রহমানকে অনুসরণ করে ভেতরে এসে চেয়ার টেনে বসলেন।

আজই প্রথম সেশন, বয়স প্রায় ৪১, দেখতে ভালোর দিকেই তবে চেহারা বিষণ্ন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

পোশাক পরিপাটি, দুটো বাচ্চা ও হাসব্যান্ডসহ অস্ট্রেলিয়া থাকেন ১১ বছর। ১২ বছর হলো বিয়ে করেছেন, একটা বাচ্চার বয়স ১০ অন্যটার ৭। নাবিলা নিজেই চিকিৎসক আর হাসব্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করেন।

বলুন আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

জ্বি, আমি একটা বাজে সমস্যার ভেতর দিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে যাচ্ছি, কী করবো বুঝে উঠতে পারি না, মাঝপথে নিজেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, অহেতুক চেঁচামেচি করি, সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, কিছুই ভালো লাগে না।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তাই এলাম আপনার কাছে, আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই, মা বছর দুয়েক হলো মারা গেছেন, আর আমার বাবা আমি যে বছর মেডিকেল ভর্তি হই, সে বছর। আমরা তিন বোন, আমি ছোট। বাকি দুই বোন বাংলাদেশে, বিবাহিত এবং ওরা দেশে বেশ ভালো আছে, অন্তত আমার চেয়ে অনেক ভালো।

আমি নিজে চিকিৎসক, বরিশাল মেডিকেল থেকে এমবিবিএস করেছিলাম। ইন্টার্নি করার সময় একটা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়, সেও ইন্টার্নি করছিল। কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম দুজনেই দুজনের প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি। এর আগেও অনেক ছেলে অনেক কিছুই বলেছে কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আর আমার আম্মু বেশ কড়া ছিলেন, যেহেতু বাবা বেঁচে ছিলেন না, মা বেশ কঠিন শাসনে আমাদের তিন বোনকে বড় করেছেন, আম্মু আগেই বলে দিয়েছিলো প্রেম করা যাবে না।

কিন্তু জাহিদকে কেন জানি বেশ ভালো লেগে গেলো। জাহিদেরও, সে তার ফ্যামিলিকে জানালো। তারা খুবই খুশি এবং সবাই রাজি। সমস্যা বাঁধালো আমার মা আর বড় চাচা। জাহিদের ফ্যামিলি ভালো, শিক্ষিত, কিন্তু জাহিদের সৎ বাবা, জাহিদের মা আর তার বর্তমান স্বামীর সঙ্গেই জাহিদ থাকতো।

বিজ্ঞাপন

জাহিদের নিজের বাবা তার মা’কে ডিভোর্স দেয় যখন জাহিদের বয়স ৩ বছর। এরপর থেকে জাহিদের নিজের বাবার কোনো খোঁজ নাই, তিনি জাহিদেরও কোনো খোঁজ রাখেননি। সৎ বাবা আর তার মা সবকিছুই করেছেন এবং জাহিদ বলতো তার এই বাবা খুবই ভালো। জাহিদের ছোট একটা বোন ছিল।

এটা আমার মা এবং চাচার পছন্দ হলো না। ছেলের বলে বাবার পরিচয় নাই, আমার চাচাতো বলেই বসলো দুনিয়ায় কি ছেলে কম পড়েছে নাকি যে এমন ছেলে দিয়ে ভাতিজি বিয়ে দেবো? ভাই নাই তো কি হয়েছে, তারা দেখে শুনে বিয়ে দেবেন। আম্মু ও আমার ওপরে বেশ রাগ।

আমি আমার বড় বোনকে ধরলাম, বড় আপা, বড় দুলাভাই বললো ছেলে পছন্দ করার আগে ফ্যামিলির খোঁজ নিবি না?
এমন ছেলে দিয়ে কেউ বিয়েতে রাজি না। অন্য ছেলে দেখ, তখন ভেবে দেখবো কী করা যায়।

বিজ্ঞাপন

আচ্ছা বলেন, তো এটা কেমন কথা। বাংলাদেশের গার্ডিয়ানরা এমন কেন? কেউ কি ফ্যামিলি দেখে কারো প্রেমে পড়ে?
তাহলে তো সেগুলো প্রেম না, ধান্দা। আর এখানে জাহিদের কি দোষ? ওরা তো কিছুই লুকায়নি আমাদের কাছে, এত ছোট একটা বিষয় কীভাবে এত মুখ্য হয়?

আর আমি একটা অবস্থাপন্ন ঘরের চিকিৎসক মেয়ে হয়েও কেন কার সঙ্গে সারা জীবন কাটাবো সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব না?
তাহলে আমাদের দেশের অন্য মেয়েদের কি অবস্থা হয় চিন্তা করেন। নাকি আমার ফ্যামিলির মানুষগুলোই এমন ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, সবাই বললো জাহিদকে ভুলে যেতে।

এত সহজ...?

বিজ্ঞাপন

মোড়ের দোকানের লন্ড্রিতে যেই একটা পিচ্চি দশ বারো বছরের ছেলে কাজ করতো, প্রায়ই আমাদের বাসায় কাপড় দিয়ে যেতো, আমি সবসময় বলতাম কাজের পাশাপাশি স্কুলে যেতে, সে সুন্দর করে দাঁত বের করে হেসে বলতো আইচ্ছা আফা...
সেই পিচ্চি ছেলেটাকেও তো এতদিনে ভুলি নাই। তাহলে জাহিদকে ভুলি কীভাবে?

জি, খুবই দুঃখজনক। বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে পছন্দের বিয়েতে ছেলের বাবা-মা সহজেই রাজি হন কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ের মা-বাবা রাজি হন না কিছুতেই, তারা মেয়ের পছন্দে আস্থা রাখতে পারেন না অথবা মেয়ের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন এবং এক্ষেত্রে মায়েরাই বেশি দাবিয়ে রাখেন মেয়েদের। অতিরিক্ত শাসন করতে গিয়ে সম্ভবত বুঝতেই পারেন না যে মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছেন এবং মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত।

জি, ডিপ্রেশনে ডুবে গেলাম, এভাবে এক বছর যাওয়ার পর ছোট চাচা এক বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এলো, ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করেছে, তখন পিএইচডি করছে, সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, দেখতেও তেমন ভালো না, দুই ভাই দুই বোন, বাবা অবসরপ্রাপ্ত, মা গৃহিনী।

বিজ্ঞাপন

এই পাত্র সবার মোটামুটি পছন্দ হলো, শুধু বড়পা বললেন, ফ্যামিলি আরও একটু ভালো হলে ভালো হতো, সবাই অত শিক্ষিত না তেমন, শুধু ছেলেটাই একটু পড়ালেখা করেছে। মেঝো বোন বললো চিকিৎসক মেয়ের পাত্র চিকিৎসক হওয়া ভালো, আমরা না হয় আর একটু দেখি।

কিন্তু আম্মু কঠোর, বলে বয়স হয়ে গেছে। এত বাছাবাছি করে সময় নষ্ট না করে বিয়ে দিয়ে দেই। ছেলে মানুষের আবার চেহারা কি, ছেলের চেহারা একটু খারাপ হওয়া ভালো, বাড়িতে বউ এর কদর থাকে। আর ফ্যামিলি....নাবিলা তো বিদেশে থাকবে, এখানে না।

আমার আম্মু বুঝলো না যে মঙ্গলগ্রহে থাকলেও মানুষ তার ফ্যামিলির আচার ব্যবহার সঙ্গে করে নিয়ে যায়...

আমাকে আপারা জিজ্ঞাসা করলো, আমি হ্যাঁ বা না বলার ঊর্ধ্বে চলে গেছি, মাথায় তখনো জাহিদ যদিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি অনেক দিন। চুপচাপ থাকলাম, নিজেই নিজের মনকে বোঝালাম, একদিন ছেলে দেখতে গেলাম। ছেলে প্রচুর কথা বলে, আমার চেয়ে ৬/৭ বছরের সিনিয়র। তবে বেশ হাসিখুশি।

বিয়ে হয়ে গেলো...

প্রথম বছর ভালোই গেলো, আমার স্বামী হোসেন আহমেদ আমার প্রতি বেশ মনোযোগী কিন্তু সে বেশ কৃপণ। সবকিছুতেই কৃপণতা করে।

দ্বিতীয় বছরে আমি অস্ট্রেলিয়া এলাম, এসেও মোটামুটি চলছিল, আমার প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় আম্মু আসলেন, এক বছর ছিল। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসকদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় পাস করি কিন্ত পার্ট টু এখনো পাস করতে পারিনি।

হোসেনের কিপ্টেমি চলতো, ভালো জামাকাপড় ও কিনতো না, খুবই সস্তা পাঁচ থেকে দশ ডলারের কাপড় কেনে। ভালো জামা বলতে ওই আমাদের বাসা থেকে ঈদে যা পাঠায় মা-বোনেরা ওগুলাই পরে ঘুরে ফিরে। বাজারও করে খুবই অল্প করে।

একটা মুরগী বা এক কেজি মাংস কেনে, ৪টা কলা, ২টা আপেল এ রকম। এমন বাজার করতে আমি জীবনেও কাউকে দেখিনি, অথচ সে বেশ ভালো চাকরি করে, খালি বাড়ি ঘর কিনতে আগ্রহী, বেশ বৈষয়িক, এমনকি দরকার লাগলে ওদের বাসায় টাকা পাঠায় খুবই অল্প পরিমাণ, সেই টাকা পাঠানোর গল্প আবার জনে জনে বলে বেড়ায় ফোন দিয়ে।

আর কথায় কথায় বাংলা স্ল্যাং বলে, সাধারণ পরিচিত স্ল্যাং না, অতি নিম্নস্তরের জঘন্য স্ল্যাং, আমি আপনাকে বলতে পারবো না।
এত বেশি বলে যে আমার অসহ্য লাগে।

আপনি কিছু বলেননি কখনো?

বলেছি, হেসে বলে বাসাতেই তো বলি। বাইরে তো বলি না।

এরপর দ্বিতীয় বাচ্চা হলো, সেবারও আম্মু আসলো। হোসেন আম্মুর বেশ খাতির যত্ন করতো। দুই বাচ্চা নিয়ে আমি পুরোপুরি হিমশিম তখনই প্রথম ধরতে পারলাম একদিন হোসেনের আসল সমস্যা।

আচ্ছা, সেটা কেমন?

সে বিভিন্ন সময় বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, যাদের নাম ছেলেদের নামে সেভ করা কিন্তু আসলে সবাই মেয়ে। হোসেন ফেসবুকে ব্লগ লেখে, খুবই সস্তা ধরনের মনোযোগ আকর্ষণের লেখা, তার বেশ কিছু ফ্যান ফলোয়ার আছে, সে সেখান থেকে মেয়েদের বেছে বেছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, যারা সাড়া দেয় তখন তাদের সঙ্গে ইনবক্সে গল্প শুরু করে, তারপরে ফোন নম্বর নেয়, এরপর এভাবে নাম লুকিয়ে গল্প করে বেড়ায়।

প্রেমের অভিনয়... সবাইকে বলে আমি খুবই বজ্জাত টাইপ নারী, তার সাথে ভালো ব্যবহার করি না, ঘরে শান্তি নাই, তাই সে একটু শান্তি খুঁজছে। একটু নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চায়। জীবনে কোনোদিন প্রেম করেনি, এখন প্রেম করতে চায়

ওহ আই সি...

জি এভাবে গল্প করতে করতে সে মেয়েদের সঙ্গে ডেটে যায়, চা কফি খায়, ছবি তোলে, বিছানায় যাওয়ার প্রস্তাবও দেয়। কারণ আমি নাকি বিছানায় জায়গা দেই না।

ভয়ঙ্কর তো

জি, এখানেই শেষ নয়, আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলো। আমার মেয়েটা বড়, ছেলেটা ছোট, ছেলের আই কন্টাক্ট ঠিক নাই। কথা বলে না, ডাকলে তাকায় না, হোসেনকে বলে চিকিৎসক অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম, ডাক্তার স্পেশালিস্ট রেফার করলো, স্পেশালিস্ট সব পরীক্ষা করে বললো আমার ছেলেটা অটিস্টিক।

লেভেল টু... আমি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকলাম। ছেলের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। আমি নামাজ ধরলাম, কান্নাকাটি করি
কিন্তু হোসেনের নোংরামিও বাড়ছে। সে পিএইচডি করছে, ভালো চাকরি করে এই কথা তার প্রতিটা স্ট্যাটাসে বলে বেড়ায়।
খুবই লোক দেখানো স্বভাব।

অস্ট্রেলিয়ায় অনেকেই বেশ ভালো জব করেন এবং পিএইচডি করা, বেশিরভাগই বেশ ভদ্র, মার্জিত। হোসেনকে কয়েকবার হাতে নাতে ধরেছি, ফোনকলও টেক্সট মেসেজসহ, তখন সে আমার হাত পা ধরে মাফ চায়, কান্নাকাটি করে, আর হবে না বলে।
দুই তিন মাস পর আবার আগের মতো।

আমি আবারো কয়েকবার পার্ট টু পরীক্ষা দিলাম অল্পের জন্য পাস করা হয়নি। আসলে হবে কি করে এত মানসিক অশান্তি। একেকটা দিন কাটানো তো অনেক কষ্ট।

অটিস্টিক বাচ্চা সামলানো কষ্ট, এর মধ্যে হোসেন এগুলো করে বেড়ায় কতদিন ধরে জানি না, নিজের জীবন নিজেরই ভারি লাগে, ভেবেছিলাম পাস করে চাকরি পেলে আলাদা হয়ে যাব, কিন্তু যতই ছেলেটা বড় হচ্ছে বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে, এত গায়ের জোর যে আমি মা হয়ে পারি না।

এর মধ্যে খবর এলো বাংলাদেশ থেকে, আমার আম্মু মারা গেলেন। তখন করোনা শুরু, লকডাউন। দেশেও যেতে পারিনি। আম্মু আমাকে বাবার পরিচয় ওয়ালা এ রকম একটা লম্পটের হাতে রেখে বিদায় নিলেন।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

চলবে...

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com