প্রবাসীর ঈদ আর আমার স্বপ্নে বাড়ি ফেরা

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:১৬ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২৩

এম আর আহমেদ (রাজ)

মানুষের জীবন অনেক রঙিন কিন্তু আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আমাদের প্রবাসীদের জীবনের সাদা আর কালো রঙের উপস্থিতি হয়তো অনেক বেশি, অন্য রংগুলো প্রবাসীদের জীবনে লুকিয়ে থাকে। এইতো কিছুদিন আগে সব থেকে বেশি রেমিট্যান্স বাংলাদেশে ব্যাংকে পাঠালো প্রবাসীরা, কিন্তু তাদের শুধু স্বপ্নে বাড়ি ফেরা হয়, প্রিয় মানুষগুলো নতুন জামা পরবে, ঈদ করবে আর প্রবাসীরা!

বিজ্ঞাপন

আমাদের প্রিয়মানুষগুলো কী আমাদের মনে রাখে যখন রং-বেরঙের জামা পরে ঈদগাহ যায়? হয়তো না, হয়তো বা হ্যাঁ। সেই ২০১৩ সালে পড়ালেখার জন্য ৭০০০ হাজার মাইল দূরে রাশিয়ায় পাড়ি জমানো, কিন্তু আমি তখনো ভাবিনি যে আমার এই পথ চলা কখনো আর বাড়ি ফেরার পথ ধরবে না, ডাটা সায়েন্স অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স পড়ালেখা শেষ করে এখন পোল্যান্ডে থিতু।

দেখতে দেখতে প্রায় দশটি বছর প্রবাসে কেটে গেছে, আলো আঁধারের খেলায়। জীবন সংগ্রামের প্রত্যকটা মুহূর্ত আমি উপভোগ করেছি, হ্যাঁ আমি উপভোগ করেছি, যখন জীবনে অন্যকোনো উপায় তখন সেই সময়টা উপভোগ করাটাই শ্রেয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমার ছোটবেলা কেটেছে তিতাস নদীর পাড়ে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলা শহরে। তিতাস নদীর পারে এখনো আমি অল্প সময়ের জন্য দেশে ফেরা হলে সেই সময়গুলো খুঁজে বেড়ায়, শান্ত তিতাসের পাড়ে বসে হারানো ছোট বেলাকে খুঁজে বেড়ায় আনমনে। একদম মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার বেড়ে উঠা, আর মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয় সবকিছু সুন্দর একটা বাজেটের মধ্যে হয়ে থাকে, আমারও ব্যতিক্রম ছিল না।

জাতীয় সংসদে যখন বাজেট ঘোষণা করা হয় যেমনভাবে, তেমনি আমরা ভাই-বোনেরা সবাই অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের বাবা কখন ঈদ বাজেট ঘোষণা করবে, প্রায় সময় ২০ রোজার পর আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, আজ হয়তো বাবা বাসায় ফিরে বাজেট ঘোষণা করবেন কিন্তু অনেক সময় তা চাঁদরাত পর্যন্ত সময় নিত আর অনেক সময় একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে আমরা কেনাকাটা করতাম আর সেই বাজেটের সময় মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল কারণ উনি সেই বাজেট পাশ করতেন।

ঈদের আগ মুহূর্ত-টা উত্তেজনায় ভরা ছিল কারণ আমরা সবাই অধীর আগ্রহে থাকতাম কার ভাগ্যে কত টাকা জুটবে কিন্তু আমরা সবাই মোটামুটি একটা পরিকল্পনা করে রাখতাম শুধু আমার বাবার কোনো প্রকার পরিকল্পনা থাকতো না, কারণ সবার বাজেট দেওয়ার পর উনার জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকতো না, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কারো কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ কখনো ছিল না, এখনো নেই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমাদের এই প্রজন্মের অনেকেই ইউটিউব, ফেইসবুক, স্যাটেলাইটের ভিড়ে আমাদের একসময়ের সবার প্রিয় ‘বিটিভি’- ঈদ পোগ্রাম হয়ত দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না, তখন কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল বিটিভি। বিটিভি প্রতিদিন অদিবেশন শুরু হত বেলা তিনটার দিকে, আর প্রতি রমজানের শেষ ২০ রোজার পর অপেক্ষা করতাম কখন ঈদ সূচি শুরু হবে আর যখন শুরু হত তখনি হাতা কলম নিয়ে বসে যেতাম ঈদ সূচি লেখার জন্য।

সে যেন এক অন্যরকম ঈদ খুশি ছিল আর বাসার সবাই আমার থেকেই বিভিন্ন নাটক আর ঈদ অনুষ্ঠানের সূচি জেনে নিত, আর আমি আমার খাতা বের করে বিটিভির ঈদের অনুষ্ঠান সূচি জানিয়ে দিতাম, যেন এক কম বাজেটের বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠানের সূচি লেখক।

অনেক দিন মায়ের হাতের সেমাই খাবার সোভাগ্য হয় না, এখানে ঈদের দিন সকালে সেমাই রানার এক অপচেষ্টা করি আমি, হ্যাঁ একদম অপচেষ্টা কিন্তু প্রত্যেকবার হয়তো চিনি বেশি হবে না হয় সেমাইতে লবণ দিয়ে এক ভিন্ন স্বাদের কিছু একটা রান্নার চেষ্টা করা।

বিজ্ঞাপন

প্রতি ঈদের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি গণনা করতাম যে আর কয়টি ঈদ আমার জীবনে আসবে, যেহেতু প্রতি ঈদ দুটি তাহলে ৫০ বছর বেঁচে থাকলে ১০০টি ঈদ হবে আর আমি এরই মধ্যে ২০টি ঈদ করে ফেলেছি, আক্ষেপ হত ঈদ কেন অনেকগুলো হয় না তাহলে এক জীবনে অনেক খুশি পেতাম কিন্তু হায় ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ইতিমধ্যে যখন লিখতে বসেছি তখন আর ২০টি ঈদ জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রবাস নামক এক সুন্দর কারাগার।

প্রবাসীদের কান্না করতে নেই, কারণ কান্না আমাদের মানায় না, আমরা যে এই সমাজের সামনে এক টুকরো হীরক খণ্ড তাই মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হবে কোনো এক দীর্ঘ রাতের শেষ দিকে, আর হাসতে হবে দিনের আলোতে যেটা সমাজ দেখে খুশি হয়। ভালো থাকুক দেশে থাকা প্রিয় মানুষগুলো, ভালো থাকুক প্রিয় প্রবাসীরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কারাগার ‘প্রবাস কারাগারে’

লেখেক, ইঞ্জিনিয়ার এম আর আহমেদ (রাজ) বি.ইঞ্জি. (পোল্যান্ড), এম এস সি (পোল্যান্ড)
এক্স ইউ-ইএস এফ স্কলার, পোল্যান্ড

বিজ্ঞাপন

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com