যদি মন কাঁদে

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৯:১৬ এএম, ০৩ আগস্ট ২০২৩

‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে॥’

প্রাথমিকের কোনো এক শ্রেণির বাংলা পাঠ্যক্রমে ‘আষাঢ়’ শিরোনামে কবিগুরুর লেখা কবিতার প্রথম দুই চরণ ছিল এমন। কবিগুরু যতই নিষেধ করুন না কেন বাংলাদেশের বর্ষার আবেদন চিরন্তন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে ভিজেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরাও দলবেঁধে বেরিয়ে পড়তাম। সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে বৃষ্টিতে ভেজা ছিল একটা উৎসবের মতো ব্যাপার।

এরপর পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া। পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে থাকলে বৃষ্টির ফোঁটার একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা যেত। আর অবিরাম বর্ষণের দিনে খড়ের চালের পচা অংশ দিয়ে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে দুর্ভোগও বাড়িয়ে দিত অনেক সময়। তাই বর্ষা আসার আগে ঘরের চালে নতুন করে ছাওনি দেওয়া হতো। ঘরামিদের ব্যস্ততা তখন বেড়ে যেত। যাদের টিনের চালের ঘর ছিল তাদের ঘরে বৃষ্টি আসতো অন্যরকম দোত্যনা নিয়ে। তবে ছাঁদের ঘরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শোনা যেত না।

‘আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।’

ছোটবেলায় আরেকটা বহুল পঠিত কবিতা ছিল কবি গুরুর ‘আমাদের ছোট নদী’ শিরোনামের একটা কবিতা। যার মধ্যে দুই চরণ ছিল এমন। এটাও বাংলাদেশের বর্ষাকালের একটা বৈশিষ্ট্য। নদীগুলো কানায় কানায় ভরে যেয়ে দুকূল প্লাবিত করে। তখন জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। সমতলভূমি বন্যার পানিতে তলিয়ে যেত।

অনেকসময় বাড়িঘর গবাদিপশু সবকিছুই বন্যার পানিতে হারিয়ে যেতো। এই দুর্ভোগ পেরিয়ে বন্যার পানি নেমে গেলে শুরু হতো পানি বাহী রোগের প্রাদুর্ভাব। অবশ্য আশীর্বাদ হয়ে জমির উপরিভাগে জমা হতো বেলে দোআঁশ মাটির পুরো আস্তরণ। আর শস্যের ফলনও যেতো বেড়ে। তাই বর্ষাকাল আর বাংলাদেশ বদ্বীপ এর ভাগ্য যেন একই সুতোয় গাঁথা।

‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান॥’

কবিগুরুর আরেকটা বিখ্যাত গানের প্রথম দুই চরণ এমন। বাংলাদেশের বর্ষাকালের সাথে কদম ফুলের ঐতিহ্য চিরায়ত। বলা হয়ে থাকে বর্ষার এক বৃষ্টিতে কদম প্রস্ফুটিত হয়। আর পরের বৃষ্টিতে ঝরে যায়। বর্ষাকালে পাখিদের খাবারের অন্যতম যোগানদাতা এই কদম ফুল। অবশ্য দুরন্ত শিশুর দল কদম ফুল পেড়ে সেগুলোর গা থেকে পাপড়িগুলো ফেলে দিয়ে বল বানিয়ে খেলে। আর কিশোরীর দল সেই পাপড়ি দিয়ে গাঁথে মালা। অন্যদিকে শহুরে যুবক তার প্রেয়সীর সামনে দাঁড়ায় বর্ষার প্রথম কদম ফুল হাতে। খুলে বলে মনের গোপন কথা। তাই ঢাকা শহরের সিগনালগুলোতে ছিন্নমূল শিশুরা কদমগুচ্ছ বিক্রি করে কিছু বাড়তি উপার্জন করে এসময়।

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়...’

বর্ষা নিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন এই গান। যে গান এখন শহুরে বর্ষাকালের সমার্থক। বর্ষা আসলেই আমাদের মন আদ্র হয়ে উঠে। আর সেই তরল মনের কথা প্রকাশ করার জন্য আমরা কদমগুচ্ছ হাতে তৈরি হয়ে থাকি। প্রিয়র দেওয়া কদম ফুল খোঁপায় গুজে তার হাত ধরে প্রিয়া বেড়িয়ে পড়বে বৃষ্টিতে ভিজতে। রিকশার হুড নামিয়ে দিয়ে কাক ভেজা হয়ে ফিরবে বাড়ি। হজম করবে মায়ের বকুনি। কিন্তু সেই বকুনি খাওয়ার মধ্যেও সে কি অনাবিল আনন্দ। আমার এক বন্ধু দেশে যেয়ে এই বর্ষায় তার প্রিয় মানুষকে তার মনের কথা জানিয়েছে কদমগুচ্ছ হাতে দিয়ে। আহা কি চমৎকার একটা ব্যাপার। ফুলের চেয়ে ভালো উপহার আর কি হতে পারতো!

অস্ট্রেলিয়াতে আলাদাভাবে বর্ষাকাল নেই। আর যৎসামান্য বৃষ্টি যেটুকু হয় সেটা হয় শীতকালে। সেই বৃষ্টিতে শখ করে ভিজলে রোগে ভোগা মোটামুটি নিশ্চিত। আর এখানে বৃষ্টি আসে শীতের প্রকোপ আরও দীর্ঘায়িত এবং প্রকট করতে। উপরন্তু এখানে বর্ষার সময় কদম ফুলও পাওয়া যায় না। প্রিয়কে মনের কথা নিজের মনেই চাপা দিয়ে রাখতে হয়। বর্ষা আসলেই তাই প্রবাসীদের মন কেঁদে উঠে। বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে দেশের বর্ষার দিনগুলোতে।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]