যান্ত্রিক নগরী কুয়ালালামপুর হবে হাঁটার শহর, ঢাকা কেন নয়
মালয়েশিয়ার রাজধানী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কসমোপলিটন সিটি কুয়ালালামপুরে নীরবে চলছে এক সবুজ বিপ্লব। আকাশচুম্বী ভবন ও উড়ালসেতুর নিচে শহরের প্রাণকেন্দ্রকে আবারও মানুষের পদচারণার উপযোগী করে তুলতে পরিকল্পনাবিদেরা কাজ শুরু করেছেন।
ছায়াময় করিডোর, ছোট পার্ক ও পথচারীবান্ধব গলিপথের মাধ্যমে গড়ে উঠছে ‘গ্রিন করিডর নেটওয়ার্ক’ — এক এমন উদ্যোগ যা কুয়ালালামপুরকে আবারও হাঁটার শহর হিসেবে ফিরিয়ে আনতে চায়।
বিদেশিদের পছন্দের কুয়ালালামপুরের বিকাশ হয়েছে গাড়ি-কেন্দ্রিক নকশার ওপর। এতে ফুটপাত ভেঙে পড়েছে, সবুজ এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আর এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় হাঁটা হয়েছে অনিরাপদ ও কষ্টকর।
জালান টুন এইচ এস লির পাশ দিয়ে জালান হ্যাং লেকিউর পেছনের গলিপথ/ছবি-সংগৃহীত
এই বাস্তবতা পাল্টাতেই বেসরকারি সংস্থা থিংক সিটি এবং কুয়ালালামপুর সিটি কর্পোরেশন (ডিবিকেএল) যৌথভাবে কাজ করছে। তারা নতুন অবকাঠামো নির্মাণের পরিবর্তে বিদ্যমান স্থাপনা ও পথগুলোকেই যুক্ত করছে এমনভাবে যেন শহরের ভেতরেই হাঁটার প্রাণ ফিরে আসে।
সিঙ্গাপুরের পার্ক কানেক্টর, নিউ ইয়র্কের হাই লাইন এবং সিউলের চংগেচন নদী প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত এই উদ্যোগে কুয়ালালামপুরের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও জায়গা পাচ্ছে।
এই হাঁটার রুটটি শুরু হয়েছে জনপ্রিয় ও জনবহুল মসজিদ জামেক এলআরটি স্টেশন থেকে। সেখান থেকে এটি ছুঁয়েছে দাতারান মেরদেকা, মেদান পাশার, সেন্ট্রাল মার্কেট, পেটালিং স্ট্রিট, এবং শেষে পৌঁছেছে কাম্পুং আটাপ পর্যন্ত।
এই পথে হাঁটলে চোখে পড়ে কুয়ালালামপুরের ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন। উপনিবেশ যুগের বাণিজ্যিক কেন্দ্র থেকে শুরু করে আজকের সৃজনশীল শহর।
জালান পার্লামেনে ‘জেজাক পাহলাওয়ান’ এলাকায় এখন একটি সবুজ সংযোগপথ তৈরি হয়েছে, যা জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত/ছবি-সংগৃহীত
প্রকল্পটির নেতৃত্বে রয়েছে থিংক সিটি, যারা স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাসিন্দা ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করছে। কুয়ালালামপুরে গাড়ির পরিমাণ বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে যানজট মুক্ত সড়ক করতে দ্বিস্তর বিশিষ্ট সড়ক, ফ্লাই ওভার, টানেল ইত্যাদি নির্মাণ করছে। আর হাঁটার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে যেন গাড়ির প্রয়োজন মানুষ অনুভব না করে হেঁটেই যায় । হাঁটার স্বাস্থ্য উপকারিতা কে না জানে। তাই কমিউনিটিকে সাথে নিয়েই করছে এই কাজ।
প্রতিটি স্থানে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা দরকার হয়— কোথায় দোকানের স্টল সরানো হবে, কোথায় সবুজ গাছ লাগানো হবে যেন হাঁটার পথ বন্ধ না হয়, আর কীভাবে ব্যবসায়ীরা নিজেদের এলাকাকে পরিষ্কার রাখবেন।
কমিউনিটি ব্যবসায়ী ও সরকারি সংস্থার প্রতিটি সমঝোতাই যোগ হচ্ছে একটি বড় লক্ষ্যে- শহরের মানুষকে আবারও হাঁটার অভ্যাসে ফিরিয়ে আনা।
এখন হকার বা পথের বিক্রেতাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টল রয়েছে, আর ঢাকা হাঁটার পথগুলো পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে নির্মিত/ছবি-সংগৃহীত
পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষ কেন্দ্রীয় পার্ক বা স্কোয়ারে জমায়েত হয়। কিন্তু এশিয়ার শহরগুলোয় জীবনের প্রবাহ দেখা যায় ফুটপাত, মার্কেটের সামনের বারান্দা ও সিঁড়িতে। এই সব ‘থার্ড স্পেস’-এর মধ্যেই তৈরি হচ্ছে শহরের সামাজিক সংযোগ।
তাই গ্রিন কানেক্টর শুধু গাছ লাগানোর প্রকল্প নয়— এটি মানুষের হাঁটার অভিজ্ঞতাকে আরামদায়ক, নিরাপদ ও স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলছে। বিশ্বজুড়ে এখন জনপ্রিয় ধারণা ‘১৫-মিনিট সিটি’— যেখানে জীবনের প্রয়োজনীয় সব কিছু হাঁটা দূরত্বে থাকে।
কুয়ালালামপুরে সেই ধারণা এখন বাস্তব রূপ পাচ্ছে। এক দশক আগে ১৫ মিনিট দূরত্বের হাঁটা ছিল যানজট ও গরমে ভরা এক ক্লান্তিকর যাত্রা। আজ সেই একই পথ আধুনিক বন্ধুত্বপূর্ণ ফুটপাত, আর্ট স্পেস ও ছায়াময় গলিপথে ১৫ মিনিট নয়, যেন মাত্র ৫ মিনিটের পথ!
এখন হকার বা পথের বিক্রেতাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টল রয়েছে, আর ঢাকা হাঁটার পথগুলো পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে নির্মিত/ছবি-সংগৃহীত
এই ধারাবাহিকতা টিকে থাকলে কুয়ালালামপুর আবারও তার পুরনো খ্যাতি ফিরে পেতে পারে—একটি শহর, যা মানুষের জন্য, গাড়ির জন্য নয়।
ঢাকা মানুষের শহর কিন্তু রাস্তায় যানজট, ফুটপাত যেন শত্রু ফলে হাঁটার উপায় নেই, তাই ৫ মিনিটের দূরত্বের রাস্তাও কেউই না হেঁটে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে! শহরের প্রতিটি পাড়া, মহল্লার রাস্তা ভর্তি রয়েছে রিকশা, রিকশার আধিক্য আর হাঁটার অযোগ্য ও দখল ফুটপাতের কারণে মানুষের হাঁটার অভ্যাসকে মেরে ফেলছে! ঢাকার মানুষ ক্রমশ: স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হচ্ছে।
ঢাকার রাজপথে ফুটপাত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর—মানুষের শহর আজ যানবাহনের দখলে/ছবি-সংগৃহীত
ঢাকায় হাঁটা পথে বিশ্রাম নেবার জায়গা নেই, নেই সবুজ গাছ যার ছায়ায় হেঁটে যাবে বহুদূর! এর মধ্যেই কষ্ট করে ঢাকার মানুষগুলো ছুটে চলে। নগরের বসতি, সড়ক ব্যবস্থা, যানবাহন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ফুটপাত ইত্যাদি সম্পর্কে অর্থাৎ সুন্দর নগর ও শহর গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনাকারী, কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংস্থা যুগের পর যুগ ধরে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টোকিও, সিউল, কুয়ালালামপুর ইত্যাদি নামকরা শহরে গিয়েছে অভিজ্ঞতা নিতে কিন্তু আজও নাগরিক বান্ধব নগর বা শহর গড়ে তুলতে পারেনি।
ঢাকার রাজপথে ফুটপাত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর—মানুষের শহর আজ যানবাহনের দখলে/ছবি-সংগৃহীত
মালয়েশিয়া নিউ ইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং সিউল থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কমিউনিটিকে যুক্ত করে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সিটি কর্পোরেশন সুন্দর নগর তৈরি করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিদেশের অভিজ্ঞতার সাথে কমিউনিটিকে, বেসরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাকে জড়িত করে সমন্বিতভাবে কাজ করে যে কোনো নগর ও শহরকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমআরএম