প্রবাসে মা হারানোর ব্যথা

বাদশাহ ভাইয়ের সঙ্গে অনেকদিন সাক্ষাৎ নেই। কোনো একটা কাজে হঠাৎ ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন? উত্তর দিলেন ‘ভালো নেই’
কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই বললো ‘আমার মা আর দুনিয়াতে নেই। দুই দিন আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। অথচ একবারের জন্য শেষ দেখা দেখতে পারলাম না।’
জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিল মায়ের? তিনি বললেন, ‘তেমন কিছু হয়নি। সুস্থ ছিল। রাতে বুকে ব্যথা উঠছে। হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। মা চলে গেছে কিন্তু মাকে এক নজর দেখার সুযোগ হয়নি আমার।’
কান্না বিজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কুয়েত প্রবাসী বাদশাহ। তার সঙ্গে পরিচয়টা অনেকদিনের। আমাদের দুইজনের বাড়ি চট্টগ্রাম হওয়াতে দেখা হলে খোঁজ-খবর নেয়া হয়। মরুর বুকে যখন একই জেলার একজন বাঙালি অন্য বাঙালিকে দেখে তখন মনটা ভরে যায়। ১ যুগের বেশি সময় ধরে কুয়েত আছেন তিনি। দুই বছর আগে দেশ থেকে ঘুরে এসে আর যেতে পারেননি করোনার কারণে।
বাদশাহ ভাইর সঙ্গে যারা কাজ করে একজন বাঙালি ছাড়া সবাই ভিন্ন দেশের। এই মুহূর্তে তাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়াটা খুব প্রয়োজন। কিন্তু কে দেবে স্বান্তনা! এই প্রবাস জীবনে চোখের পানি মুছে দেয়ার যে কেউ নেই। কোম্পানি থেকে নাকি দুইদিনের ছুটি নিয়েছেন।
এই দুইদিন বাসায় বসে বারবার অতীতে ফিরে যাবে। স্বজন হারানোর ব্যথা যে অনেক কষ্টের। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার জানাজা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। মায়ের কবরে এক টুকরা মাটি দেয়ার যে সুযোগ হয়নি তা কি করে ভুলবে!
জিজ্ঞেস করলাম কী করবেন? দেশে চলে যাবেন? তিনি বললেন, ‘কিভাবে যাব? করোনার কারণে প্রায় এক বছর যাবৎ ফ্লাইট বন্ধ। কি করব বুঝছি না। যদি করোনা না থাকত আজ, হয়তো শেষবারের জন্য হলেও মায়ের মুখ দেখতে পেতাম। এক করোনা যেমন মানুষের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে তেমনি অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। যদি দেশে যায় তাহলে একবারে চলে যাব।’
অনেকদিন থেকে বলে আসছিলেন শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। দেশে যাওয়া খুব প্রয়োজন। মা, স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে খুব ইচ্ছা করে। বললাম এখন গেলে তো আর আসতে পারবেন না। ফ্লাইট চালু হোক তারপর যাইয়েন। কিন্তু ফ্লাইট চালু হওয়ার আগেই যে মা চলে গেলেন।
দূর দেশে বসে স্বজন হারানোর বেদনা কতটা নিষ্ঠুর হয়, সেটা শুধু তারাই উপলব্ধি করতে পারবে যারা এ ধরনের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে। বাদশাহ ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিন যেহেতু প্রবাস জীবন কাটিয়ে দিলেন এবার দেশে গিয়ে সময় কাটাব। মায়ের হাতের রান্না খাব। প্রিয়জনদের সময় দেব। কিন্তু বিনা মেঘে বর্জ্যপাতের মতো এমন একটা সংবাদ আসবে কল্পনাও করেনি।
বাস্তব ও নির্মমতার কাছে হার মানতে হয় বাদশাহ ভাইর মতো হাজারো প্রবাসীর। যে মা তার সন্তানদের নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করেন বলে সন্তান কখনোই তার প্রবাস জীবনের কোন কষ্টের কথা তার মাকে জানায়নি, অথচ সেই মাকে হারানোর বেদনা আর কষ্ট নিয়ে প্রতিটি ক্ষণ পার করতে হচ্ছে সন্তানদের।
বাবা বলে, বুকে টেনে নেওয়া মাকে বাদশাহ শেষবার দেখেছিল দুই বছর আগে। হয়তো মা চাইনি তার সন্তানকে বিদায় দিতে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে চলে যে আসতে হবে।
বাবা-মায়ের হাজারও স্মৃতি এভাবেই বুকে আকঁড়ে ধরে, কান্না চেপে রেখে, কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে স্বপ্ন পূরণে এক পা, দুই পা করে এগোচ্ছে প্রবাসীরা। প্রবাস হয়তো দিতে পারে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, তবে মুহূর্তের মধ্যে এটি ছিনিয়েও নিতে পারে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্ক আর বন্ধনকে। জীবনে সুখের সময় এভাবে হারিয়ে যায় প্রিয় মানুষগুলো। একটিবার দেখার সুযোগ হয় না। লক্ষ কোটি টাকা থাকলেও সে টাকা তখন কাজে আসে না।
এমআরএম/এমকেএইচ