নীলনদের ছোট্ট দ্বীপে যেন ‘সবুজ বাংলাদেশ’

আফছার হোসাইন
আফছার হোসাইন আফছার হোসাইন মিশর থেকে
প্রকাশিত: ০৪:৪৪ পিএম, ১৬ জুন ২০২২
প্রবাসী বাংলাদেশি আলমগীর হোসেন

ইউরোপে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে ১৫ বছর আগে ট্রানজিট ভিসায় মিশরে নেওয়া হয়। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করে আদম ব্যাপারী তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে রাজধানী কায়রোতে ফেলে যান। এরপর শুরু হয় জীবনযুদ্ধ! প্রবাসী আলমগীরের স্বপ্নগুলো অধরা রয়ে গেলেও হতাশা কাটিয়ে নীলনদের একটি দ্বীপে গড়ে তুলেছেন ‘সবুজ বাংলাদেশ’।

কায়রোর কূটনৈতিক পাড়া আল-মাদির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিশ্বের দীর্ঘতম ঐতিহাসিক নীলনদ। সুদান, কঙ্গো, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া ও মিশরজুড়ে বিস্তৃত এই নীলনদে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

ছোট একটি দ্বীপের নাম জাজিরাতুল মাদি। এ দ্বীপেই আলমগীর হোসেন নামে এক বাংলাদেশি গড়ে তুলেছেন ‘তাজা এগ্রো’ নামের ছোট্ট একটি কৃষি ফার্ম।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার জন্য ১৫ বছর আগে মিশরে এসেছিলাম। এখানে বাংলাদেশের কোনো শাক-সবজি পাওয়া যায় না। তাছাড়া টাকা-পয়সাও খুব একটা ছিল না। তাই নিজেই উদ্যোগী হই। দেশ থেকে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজির বীজ ও চারা সংগ্রহ করি। নীলনদের এই দ্বীপের কয়েক শতাংশ জমি লিজ নিয়ে কাজ শুরু করি। গরু না থাকায় দ্বীপের স্থানীয় চাষিদের থেকে দুটি গাধা ও কোদালের ব্যবস্থা করে চাষাবাদ শুরু করলাম।

jagonews24

তিনি বলেন, শৈশবে পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেছি, সেই থেকে কিছু অভিজ্ঞতা আর চ্যানেল আইয়ের শাইখ সিরাজের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান দেখেই আমার কৃষি শিক্ষা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

‘এই দ্বীপের জমি খুবই উর্বর, কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ছাড়া শুধু নীলনদের পানি দিয়েই সব ধরনের শাক-সবজি ফলানো হয়। ফলনও আশানুরূপ। প্রতি বছরই জমির পরিমাণ বাড়াচ্ছি। আমার সবজি মিশরের বন্দর নগরী আলেক্সান্ড্রিয়াসহ রাজধানী কায়রোর বড় বড় শপিংমল নিয়ে যায়।’

jagonews24

তিনি বলেন, বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক প্রবাসী বাগান দেখতে এবং সবজি কিনতে আসেন। তাদের নিজ হাতে সবজি তুলে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। পছন্দ অনুযায়ী টাটকা শাক-সবজি তুলে নিয়ে যান। সবাই এখানকার সবজি খুব পছন্দ করেন।

বিজ্ঞাপন

‘মিশরে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত ও তাদের সহধর্মিণীরা সবজি নিতে আসেন এই বাগানে। তারা দ্বীপটিতে কিছুক্ষণ সময় কাটান ও নিজ হাতে সবজি তোলেন। রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিয়মিত বাগানে এসে আমাকে উৎসাহিত করেন। এমনকি বাংলাদেশ থেকে মিশর সফরে আসা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলও সবজি বাগান পরিদর্শন করতে আসে।’

jagonews24

প্রবাসী চিকিৎসক তৌহিদ, দীর্ঘদিন যাবত সপরিবারে মিশরে বসবাস করছেন। প্রায়ই যান মাদি দ্বীপে আলমগীরের বাগান থেকে সবজি কিনতে। এদেশে সবজি বলতে পাওয়া যায় বেগুন, আলু, জুকিনী, পালংশাক ও টমেটো। সচরাচর বাংলাদেশি কোনো শাক-সবজি বা পণ্য পাওয়া যেত না মিশরে। ঠিক এমন সময়ে আলমগীর হোসেন প্রথম উদ্যোগ নেন দেশি সবজি চাষের।

বিজ্ঞাপন

ধীরে ধীরে তার নিরন্তর প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে নীলনদের আল-মাদি নামের এই দ্বীপে গড়ে ওঠে চমৎকার দেশীয় সবজির বাগান ‘তাজা এগ্রো’। আর কী নেই সেই বাগানে?! শিম, করলা, লাউ, বরবটি, সজনে, কাঁচকলা, কচুরলতি, কাকরোল, ঢেঁড়স, কাঁচামরিচ, পুঁইশাক এমনকি কলমিশাক ও পেঁপে। এ যেন মরুর বুকে এক টুকরো ‘সবুজ বাংলাদেশ’!

jagonews24

তৌহিদ বলেন, প্রায়ই যাওয়া হয় আলমগীরের বাগানে সবজির খোঁজে। এছাড়াও দেশি সবজি এখন মিশরীয় সুপারমার্কেটগুলোতেও সরবরাহ করে ‘তাজা এগ্রো’। গুণগত মানের সঙ্গে দেশীয় সবজির চাহিদাও পূরণ করছে আলমগীরের সবজি বাগান।

বিজ্ঞাপন

‘আমরা যে শুধু বাংলাদেশি শাক-সবজি আনতে যাই ঠিক তা নয়। এই দ্বীপে গেলে প্রিয় জন্মভূমির একটা ঘ্রাণ পাই, বারবার যেতে ইচ্ছে করে। এখানে যতক্ষণ থাকি মনে হয় যেন দেশেই আছি। এ যেন নীলনদের বুকে ছোট্ট এক বাংলাদেশ।’

মিশরে থেকে এমন তরতাজা সবজি পাওয়ার আনন্দটাই ভিন্ন, যা কি না প্রবাসে না থাকলে ঠিক বোঝানো যায় না। ধন্যবাদ আলমগীর হোসেনকে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

আলমগীরের সবজি বাগানে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি অনেক মিশরীয় শ্রমিক কাজ করেন। তার মধ্যে একজন আশরাফ সাঈদ।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি এই দ্বীপেরই বাসিন্দা, আলমগীর হোসেনের সবজি বাগানে কাজ করি দীর্ঘদিন থেকে। বাংলাদেশের সবজি করলা, কাঁচামরিচ, লাউ, ছোট বেগুনসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি চাষ করি।

jagonews24

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

‘আলমগীর খুব ভালো মানুষ। এই দ্বীপের অনেকেই আমার মতো এই সবজির বাগানে কাজ করে তাদের সংসার চালায়। এই বাগানের সবজি কায়রোসহ অন্যান্য শহরের বড় বড় সুপারশপে যায়। যার ক্রেতা বেশিরভাগ বিদেশি। এই দ্বীপের মাটি খুবই উর্বর, আবহাওয়াও খুব চমৎকার। রাসায়নিক সার ছাড়াই শুধু নীলনদের পানি দিয়েই এখানে সবজি ফলানো যায়।’

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com