আস্থা-অনাস্থা

পারিজাত রহমান খুবই মনযোগ দিয়ে সামনে বসে থাকা দুজন মানুষকে দেখছেন। তারা সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী। দুজনেরই মুখ কালো। একটু আগে তার সামনেই এক দফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে দুজনের।
মাঝ পথে কথা বলে থামিয়েছেন দুজনকে। তানাজ রহমান এবং হিসাম মাহমুদ, এসেছেন টিন এজ ছেলে মেয়ের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে।
পারিজাত রহমান বললেন আমি বরং একজন একজন করে কথা বলি আপনাদের সঙ্গে, এরপর না হয় একসাথে দুজনকে ডাকবো, কে আগে বলবেন তিনি থাকুন, অন্যজন বাইরে গিয়ে একটু বসুন প্লিজ...
এ কথা শোনার পরে দুজনেই পারিজাত রহমানের দিকে তাকিয়ে রইলো, হঠাৎ তানাজ রহমান বলে উঠলেন জী আচ্ছা আমি তাহলে আগে বলি...
হিসাম মাহমুদ চুপচাপ উঠে বাইরে চলে গেলেন।
পারিজাত রহমান বললেন, জী বলুন
আমাদের দুটো ছেলেমেয়ে, একজনের বয়স ১২, অন্যজনের ৯। দুজনেই বয়সন্ধিকালে, এদের যখন তখন মুড সুয়িং হয়, এছাড়া এটা সেটার আবদার লেগেই আছে। প্রবাস জীবন এমনিতেই আমরা নিজেরাই অনেক ব্যস্ত থাকি, এর মাঝে আমি চেষ্টা করি আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে বাচ্চাদের শেখাতে যেন তারা ছোটবেলা থেকেই সবকিছু রপ্ত করে ফেলে।
অভ্যাসে পরিণত হয়, বড় হয়ে কষ্ট না হয়, কিন্তু হিসাম কিছুই শেখাতে দেবে না, খালি বলে বড় হয়ে শিখে নেবে, এই যে একটু আগে কথা কাটাকাটি আপনার সামনেই টিচার নিয়ে, ছেলেটা ক্লাস সেভেনে উঠে গেছে, হাই স্কুলে যায়, এদেশের অংক করানোর ধরণ আলাদা, আমি প্রাইমারি পর্যন্ত পড়িয়েছি, এত বললাম একটা অংকের টিচার দেই, হিসাম দিতে দেবে না।
অথচ আমার ছেলের সব বন্ধুদের দুটো তিনটা টিচারের কাছে দৌড়ায়, কোচিং করে। ছেলেটা বাসায় এসে বলে আমাকে সেগুলো কিন্তু হিসামকে বলে না, কিছুটা ভয় পায় বাবাকে, মা হয়ে এমন বিপদে পড়েছি...
আমি কিন্তু কখনো হিসামকে বলিনি কোচিং দিতে হবে, বলেছিলাম ইংরেজি আর অংকের দুইটা টিচার দিতে। দেবে না, আরবি পড়াবে না, সুইমিং ক্লাসেও দেবে না, কোনো টাকাই সে খরচ করবে না বাচ্চাদের পেছনে, বলে এদেশের ছেলে পেলেরা কেউ এসবে দৌড়ায় না, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ান আর চাইনিজ বাবা-মা রা দৌড়ায়, দেখুন কথাটা কিন্তু ঠিক নয়।
ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো হলে অজিরাও (প্রতিবেশী) শিক্ষকের পেছনে দৌড়ায়। ওই দিকে মেয়েটা কারাতে শিখতে চায়, আমিও চাই ছেলে মেয়ে দুজনেই সাঁতার, কারাতে শিখুক, যেই যুগ! আমি তো চাইবোই ওরা নিজেদের আত্মরক্ষা করতে যা যা প্রয়োজন শিখুক কিন্তু হিসাম কিছুতেই রাজি হয় না, উল্টা-পাল্টা যুক্তি, ঝগড়া, মনোমালিন্য ইত্যাদি চলছেই।
শেষে আমি একদিন বললাম, আমি তো একটা পার্টটাইম চাকরি করি, সংসারে ফার্নিচার বা এটা সেটা কিনি, নিজের জামা কাপড়, ব্যাগ শাড়ি ইত্যাদি নিজের টাকাতেই কিনি, হিসামকে বললাম ছেলেমেয়েদের পড়ার ও সাঁতার শেখার খরচটা আমি দেই, তোমার দেওয়া লাগবে না।
এতেও রাগারাগি, চিৎকার চেঁচামেচি...আমার নাকি দুই টাকা কামাই করে ফুটানি বাড়ছে, এ ধরনের ফালতু আজেবাজে কথা কতক্ষণ ভালো লাগে? নিজের আয় করা টাকা নিজের সন্তানের জন্য খরচ করতে পারি না, বলেন ভালো লাগে? তাহলে দেশ, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে বিদেশে থেকে কি লাভ? সামর্থ থাকার পরেও বাচ্চাদের কোনো সুযোগ সুবিধা দিতে পারি না।
পারিজাত রহমান বললেন আচ্ছা, বুঝলাম...
আপনার কি মনে হয়, উনি এমন কেন করেন?
কিছুই না, কিপ্টামি
টাকা জমায়, আর দেশে গিয়ে ফুটানি করে উড়ায়...
দেখায় আত্মীয়-স্বজনকে, সেগুলো তার কাছে জরুরি।
আর দেশের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব ভাবে আমরা না জানি কত ধনী, অথচ বাচ্চাদের কোনো প্রয়োজন বা শখ পূরণ করতে পারি না।
চলবে...
এমআরএম/জেআইএম