কীসে আটকায় নারী অথবা পুরুষ?

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৩২ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২৩

ড. আনোয়ার শাহদাত

সামাজিক মাধ্যম ও বৈকালিক আড্ডায় ইদানীং উষ্ণ বিষয় হচ্ছে নারী কীসে আটকায় এবং পুরুষ কীসে আটকায়। আমার এক প্রিয় মানুষ হঠাৎ সেদিন ফোন দিয়ে আমার মতামত জানতে চাওয়ায় এই লেখার জন্ম।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্নগুলো অশ্লীল, কুরুচিকর এবং নারীবিদ্বেষের বহিপ্রকাশ। এ জাতীয় প্রশ্নের মাধ্যমে ‘Domestic violence and abuse’ কে মেনে নেওয়ার প্রচ্ছন্ন চাপ আছে। এই প্রশ্নে স্বাধীনচেতা ও সাহসী নারী-পুরুষকে অপমানিত করার চেষ্টা হয়েছে।

নারীকে আটকাতেই কেন হবে? গরু ছাগল খুঁটি দিয়ে আটকায়, নারী কি তবে তাদের কাছে গরু ছাগলের মতোই গৃহপালিত প্রয়োজনীয় প্রাণী। সিকি শতাব্দী আগে ১৯৯৮ সালে একটি সিনেমা মুক্তি পায়, ‘মেয়েরাও মানুষ’ নামে। এই সময়ে এসেও আমাদের চিৎকার করে বলতে হবে নারীও মানুষ?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একটি দম্পতি অত্যন্ত ভদ্রচিত পন্থায় নিজেদের আলাদা করে নিলো, পারস্পারিক সম্মতি ও সম্মান বজায় রেখে, আর আমরা সেই সুন্দর বিচ্ছেদকে ব্যবহার করছি নারীদের খোচাতে? এই আমাদের শিক্ষা? এত ভয়ঙ্কর ও অবিবেচক আমাদের সমাজ?

পশ্চিমের ভালোবাসা ও একসাথে থাকার ধারণা আমাদের মতো না। পশ্চিমের মানুষ মুক্ত আর স্বাধীন। অনুভূতির পরিবর্তন হলে, আর ভালো না লাগলে তাদের ওপর কোনো চাপই কাজ করে না। তারা যতদিন একসাথে ভালোবাসে, ভালোলাগে বলেই থাকে থাকে। জোর করে, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে থাকে না। পশ্চিমা ভালোবাসায় আপসকামিতা গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা কেন একসাথে থাকি? চারপাশে যা দেখেছি তাতে, ৩০ শতাংশ সংসার টিকে আছে বাচ্চারদের কি হবে এই ভেবে। ২০ শতাংশ টিকে আছে সমাজ ও পরিবারের চাপে। ২৫ শতাংশ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ভয়ে, ১৫ শতাংশ মামলা মোকদ্দমার ভয়ে, ৫ শতাংশ অভ্যাসে, ৪ শতাংশ সাহসের অভাবে, ১ শতাংশ সম্ভবত টিকে আছে কিছুটা হলেও ভালোবাসার প্রাপ্তিতে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মতের মিল না হলেই স্ত্রীকে বেধড়ক পিটুনি দেওয়াতে আমাদের শিক্ষিত ভাইয়েরাই এখন আর পিছিয়ে নেই। আমার এক পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিদিনই নিয়ম করেই বউ পেটান। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়রসহ উচ্চশিক্ষিত অনেক মেয়েরাই বিয়ের পরে চাকরি বা পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এখনো এই দেশে। জোর করে বোরকা পরানোতো ডাল ভাত। বিয়ের পরে, পূর্বের যাপিত সামাজিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ও খাচায় বন্দি জীবনের সূচনা হয় অগণিত মেয়েদের জীবনেই।

শুধু যে আমাদের মেয়েরাই আটকে আছে সে রকম নয়, আমাদের ছেলেরাও আটকে আছে। মিথ্যা মামলা, উচ্চ কাবিনের চাপ, সামাজিক চাপ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

প্রেম ভেঙে গেলে মেয়েটি ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের’ মিথ্যা মামলা দেয়, এমন খবর প্রতি সপ্তাহেই কাগজে আসে। পাঁচ বছর ধরে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, এমন কিম্ভূতকিমাকার মামলায় গ্রেফতার হয় ও বিচার চলে।

বিজ্ঞাপন

দাম্পত্য়ে ঝগড়া হলে স্বামীর নামে যৌতুকের দাবিতে মামলা এখন এতই সাধারণ যে তা আর খবরেরও যোগ্য নয়। কাবিনের অঙ্ক এতই বড় এবং অথবা, মেয়ের পরিবার প্রভাবশালী, তাই ভয়ে সিটিয়ে কোনোমতে জীবন কাটাচ্ছে এমন উদাহরণ হরহামেশাই দেখা যায়। সামাজিক চাপ ও পৌরুষ নিয়ে নোংরা মন্তব্যের কাটাতো আছেই।

চলে যেতে চাইলেই তারা যেতে পারে না। সমাজ আর একটু সহনশীল হলে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে, পরবর্তী জীবন সুন্দর হবে এই সাহস পেলে, অনেক আটকা আটকির বাধন আগেই ছিঁড়ে যেত।

আমার খুব লজ্জা হয় যখন দেখি আমরা এমন এক উদ্ভট সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করেছি যেখানে মানুষের ভালোবাসার স্বাধীনতার চেয়ে এক টুকরা কাগজের দোহাই দিয়ে আটকানোকে জায়েজ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

কোনো রকম ভালোবাসার বাঁধন ও মর্যাদাবোধ ছাড়াই, একটি সম্পর্ক টিকে আছে কিছু চাপের জন্য, এর চেয়ে বড় অসম্মানের আর কি হতে পারে? জোর করে আটকে থাকার বা রাখার চেষ্টা মানুষের সৃষ্টিশীলতায় সবচেয়ে বড় আঘাত।

বিচ্ছেদ কি বিয়ের মতোই একটি স্বাভাবিক বিষয় নয়? একবার বিয়ে হয়েছে বলেই মেরে-কেটে, জীবন ধ্বংস করে হলেও টিকে থাকতে হবে? সহমরণে যেতে হবে? সব অবিচার অত্যাচার অসম্মান মেনে নিয়ে আটকে থাকাটাই জীবনের স্বার্থকতা?

সুস্থ ও চমৎকার সহযোগিতাপ্রবণ নারী পুরুষেরও প্রচুর উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে। আমার চিকিৎসক সহকর্মীদের (নারী ও পুরুষ) এক বিরাট অংশ, তাদের জীবনে তাদের সঙ্গীর ভূমিকাকে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথেই স্মরণ করে থাকে।

বিজ্ঞাপন

আমি বিশ্বাস করি, মানুষের মতো বুদ্ধিমান ও সৃষ্টিশীল প্রাণীকে কোনো কিছু দিয়েই আটকানো যায় না, আটকানো উচিৎ না। মানুষ বন্দি নয়, আজন্ম স্বাধীন। মানুষের স্বার্থকতা আটকে দিয়ে বা আটকে থেকে নয়, বরং ভালোবাসা সম্মান ও মর্যাদাবোধে।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

ড. আনোয়ার শাহদাত, ডক্টর অ্যাট ইন্টারফেইথ মেডিকেল সেন্টার, নিউইয়র্ক

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com