কলি ছিল মা-বাবার সাত রাজার ধন

প্রদীপ মাহবুব
প্রদীপ মাহবুব প্রদীপ মাহবুব
প্রকাশিত: ০৫:০৮ পিএম, ১৭ মে ২০২৪

কলি, সম্পর্কে আমার মামাতো বোন। সে আমার চেয়ে বছর তিনেক ছোট। সে খুবই শান্ত স্বভাবের ও অসম্ভব রকমের কর্মঠ ছিল। সে বাবা-মায়ের অনেক আদরের সন্তান ছিল। পাঁচ বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। শুধুমাত্র সংসারের বড় সন্তান হওয়ার জন্যই সে আদরের ছিল ব্যাপারটি কিন্তু সে রকম নয়। কলির জন্মের আগেও তার বাবা মায়ের কোলজুড়ে এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান পৃথিবীতে এসেছিল। কিন্তু অকালেই দুটি সন্তানই মৃত্যুবরণ করে।

পরপর দুটি সন্তানের মৃত্যুর পর কলির জন্ম। আর এজন্য বাবা-মায়ের কাছে কলি ছিল আরাধ্য। কলির জন্মের পরে তার বাবা-মায়ের কোলজুড়ে সানি নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল। সানির বয়স যখন তিন বা চার তখন তার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে এবং সে অকালে মৃত্যুরবণ করে। সানির মৃত্যুর পর পপি নামের আরও একটি কন্যা সন্তান মৃত্যুবরণ করে। কলিসহ পাঁচ সন্তান জন্ম লাভ করলেও অন্য চারজনের মৃত্যু কলির বেঁচে থাকাটা তার মা-বাবার কাছে গুপ্তধন পাওয়ার মতো ছিল। এরপর আরও পাঁচটি মেয়ে ও একটি ছেলে পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে ওঠলেও কেউ-ই কলির জায়গাটা দখল করতে পারেনি। এভাবেই কলি হয়ে উঠেছিল মা-বাবার সাত রাজার ধন।

কলির বেড়ে ওঠা আমাদের চোখের সামনেই। বাড়ির অন্যসব বাচ্চাদের চেয়ে কলির হাঁটাচলা শেখা ছিল ভিন্ন ধরনের। সে দুই হাঁটুতে হাতে ভর দিয়ে দিয়ে হাঁটতো। এটা নিয়ে বাড়ির অনেকে মজা করতো। শান্তশিষ্ট আর নরম স্বভাবের জন্য বাড়ির সবার কাছে কলি ভালো মেয়ে হিসেবেই পরিচত ছিলো। কলির জীবদ্দশায় তার গায়ে কেউ কখনওই হাত তোলেনি। তবে তার বাবা একবার রাগ করে তার গায়ে হাত তুলেছিল। সেটাও সে যখন পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে ছিল। তাতে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো! এতে তার মায়ের আর নানির কী কান্না!

কলির শিশুকাল কেটেছে কিশোরগঞ্জ সদরে। সেই ৮০’র দশকে তার বাবার কিশোরগঞ্জ শহরে সাইকেল ও রিকশার দোকান ছিল। কলির নানির বেশ জায়গা জমি ছিল। বাড়িতে অনেক ফলমূলের গাছ ছিল। বিশেষ করে জাম্বুরা, তেঁতুল, নারকেল, পেয়ারা, আম আর কাঁঠাল গাছ। তার নানি তাকে এত আদর করতো যে, গাছের সব ফলমূল কলির জন্য রেখে দিতো। ফলমূল নষ্ট হয়ে গেলেও কাউকে না দিয়ে ঘরে রেখে দিতো। নানি গাছ থেকে এসব ফল সংগ্রহ করার জন্য আমার আর ইকবালের সাহায্য নিতেন।

আমরা দুইজন গাছে গাছে চড়ে ফল সংগ্রহ করতাম। এসব সংগৃহীত ফল বিশেষ করে আম নানি কলির জন্য রেখে দিতাম। আমরা এত পরিশ্রম করে আম সংগ্রহ করার পরেও তিনি আমাদের সবচেয়ে ছোট ও পোকায় খাওয়া আমটি দিতেন। এই একটা আম দেওয়ার জন্য তিনি পাত্রের সবগুলা আম ভালো করে চেক করে সবচেয়ে ছোট আর পোকায় খাওয়া আমটি দিতেন। এতে করে আমাদের মন খারাপ হতো।

এরপর থেকে আমি আর ইকবাল যুক্তি করে গাছে উঠতাম। নানি যেহেতু আমাদের আম দেবেনই না সেহেতু আমরা গাছেই যা খাওয়ার খেয়ে নেবো। নানি বয়সের ভারে ন্যুব্জ ছিলেন। তিনি চাইলেও ওপরের দিকে দেখতে পারতেন না। তাই গাছের ওপরে কি করছি তা তিনি দেখতে ও বুঝতে পেতেন না। আমরা গাছে উঠার পর ইচ্ছা মতো পেট ভরে আম খেতাম। শুধু তাই নয়, বড় বড় ও ভালো আম ঢিল দিয়ে দক্ষিণের ক্ষেতে ফেলে দিতাম যাতে পরে খেতে পারি। ঢিলের শব্দ শুনে নানি বলতেন, কীরে পজিব, কীরে ইব্বল, শব্দ ক্যার? আমরা বলতাম, নানি ফক্ষি আম খায়ালাইছে।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে

তাই আমের বড়া ক্ষেতে ফালায়া দিছি! আমরা মনের সুখে বড় বড় পাকা আম খেতাম আর বাকিগুলো মাটিতে ফেলতাম। ছোট ছোট আম দেখে নানি বলতেন, হারামজাদা ফক্ষি, আমার সব বালা আম খায়ালাইছে, আমার কলু কি খাইবো? নানির আম পাড়ার জন্য পারিশ্রমিক নিলেও একটা কাজের জন্য আমরা পারিশ্রমিক নিতাম না। নানির ঘরে ছিল চামচিকার বসবাস। শত শত চামচিকা সিলিং এর ওপর থাকতো। হাতে দুজনে দুটা ঝাড়ু নিয়ে সিলিং এর ওপরে উঠতাম আর মনের সুখে চামচিকা মারতাম! কলি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার বাবা-মায়ের কোলজুড়ে আরও বেশ কয়েক সন্তান পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তার নানি কলি বলতেই পাগল ছিলেন।

কলির বাবা ব্যবসায় লস করায় কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রামে চলে আসেন। কথিত আছে যে তিনি সংবাদপত্রের প্রতি এত মনযোগী ছিলেন যে তিনি কাস্টমারের প্রতি খেয়াল রাখতেন না। এটা ছোটবেলায় আমরাও দেখেছি। কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসার পর গ্রামেই কলির বেড়ে ওঠা। দেখতে দেখতে কলি বড় হয়ে ওঠলো। এর মধ্যে কলির নানিও মারা গেলেন। স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি সংসারের সকল কাজে সে সহায়তো করতো। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কলির বিয়ে হয়ে গেলো। তার বড় চাচা একটা ভালো ঘরের ছেলে দেখে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তবে এই বিয়েতে কলির ফুফুর মত ছিলো না। কেননা তার ফুফু চেয়েছিলেন কলিকে ছেলের বউ হিসেবে নিতে। কিন্তু কেন জানি কলির বাপ-চাচা মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হননি।

কলির বর ছিলেন প্রবাসী। নাম ছিল তার জজ মিয়া। জজ মিয়া আর আট দশটা প্রথাগত জামাইয়ের মতো ছিল না। সে শ্বশুর বাড়ি এসে সবার সাথে হাসি ঠাট্টা করতো। গ্রামের অন্য জামাইয়েরা যেভাবে ভাব গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলতেন তিনি ঠিক তার উল্টোটা ছিলেন। তিনি শ্বশুর বাড়িতে এসে নানারকমের বায়না ধরতেন। তার বায়না পূরণ করার জন্য কলির মা উঠেপড়ে লাগতেন। তবে এ নিয়ে কলির বাবা মাঝে মাঝে বিরক্ত হতেন।

এভাবতেই চলতে থাকলো কলির সংসার। দেখতে দেখতে কলির এক পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। কলি তার ছেলের নাম রেখেছিলো প্রথম। বিয়ের পর প্রায়ই কলি বাবার বাড়ি আসতো। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতো, বালাই আছি, আলহামদুলিল্লাহ্। সে বাবার বাড়ি এসে সবার সাথে এমনভাবে মিশতো যে মনে হতো তার মতো সুখী এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই! স্বামী-সন্তান নিয়ে তার স্বর্গের সুখ।

চলবে...

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]