তোমার কাছে জীবনের প্রথম চিঠি লিখছি
অমিয় দাশ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
আমার একটা দুটা ডিএনএ তো তোমার সাথে থাকলে মনে হবে আমি আছি তোমার বালিশের নিচে, সিন্ধুকে অনেকদিন, কিংবা ওয়েস্ট বাস্কেটে অল্প কিছুক্ষণের জন্য। সে যাই হোক আছি তো। শুনেছি যত্নে থাকলে ডিএনএ নাকি অনেকদিন বাঁচে।
তারপর জানো কী হয়েছে? আমি সময় করে পোস্ট অফিসে গেলাম। অলস পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে স্ট্যাম্প কেনার জন্য পোস্ট অফিসে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে আট-দশ জন লোকের পেছনে আমি দাঁড়িয়ে। কারো কাছে কোনো চিঠির খাম দেখলাম না। প্রায় সবার হাতেই কম বেশি নগদ টাকার গোছা, বান্ডিল দেখলাম।
লোকজন কি কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে এসেছে আমার মতোই স্ট্যাম্প কিনতে? নিজেকে আর একা মনে হলো না। দেখলাম সামনের লোকজন কেউই স্ট্যাম্প কিনলো না। কেউ টাকা জমা দিলো, কেউবা টাকা তুললো, গুনে গুনে হিসাব করে নিলো। এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম পোস্ট অফিস এখন আর পোস্ট অফিস নেই। ‘পয়সা অফিস’ হয়ে গিয়েছে। টাকা পয়সা ওঠানো, রাখা, লগ্নি করা ইত্যাদি কাজ চলছে ওখানে।
কাউকে কেউ মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাচ্ছে না। এখন ব্যাংক আর পোস্ট অফিসের মাঝে তেমন কোনো তফাৎ নেই বললেই চলে। প্রায় আশাহত ভঙ্গিতে ডাকটিকেট আছে কি না জিজ্ঞেস করলাম বিজ্ঞ চেহারার পোস্টমাস্টার লোকটিকে। আমাকে বেশ পরখ করে দেখে নিয়ে সে একটা ড্রয়ার হাতড়ে একটা ময়লা পুরনো খাতা বের করে জিজ্ঞেস করলো,
‘চিঠি কি দেশের ভেতরে, না বিদেশে যাবে?’
আমি খামটা একটু উচিয়ে দেখিয়ে বললাম,
’দেশের ভেতরে।’
- আগের পর্ব পড়ুন
সারাজীবন মনে রাখার মতো মধুর ঘটনা
ওই বলেই একটা ডাক টিকিট এগিয়ে দিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, ‘৫ টাকা খুচরা আছে? আমার কাছে খুচরা নেই।’ আমি আমার সঞ্চয় করা টাকা নিয়ে চিঠি পোস্ট করতে গেছি। সবই খুচরা টাকা, কয়েন, ইত্যাদি আমার পকেটে। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। পোস্টমাস্টার একটা ডাকটিকিট এগিয়ে দিলো। ডাকটিকিটটা দেখে আমার ঠিক পছন্দ হলো না। কি সব হিজিবিজি, কিসের একটা ফটো যেন। ছাপানোটাও পরিস্কার হয়নি।
ওই ডাকটিকিটের দাম অর্ধেক হওয়া উচিৎ। দামাদামি করার এখতিয়ার থাকলে, ঠিক জিগ্যেস করতাম যে অর্ধেক দামে ওই ডাকটিকিট আমার কাছে বিক্রি করবে কি না। তোমার কাছে আমি জীবনের প্রথম চিঠি লিখছি। মনে রাখার মতো আর্টিস্টিক একটা ডাকটিকিট আঁটাতে হবে খামের ওপর, যেন ওটা দেখেই তোমার মন ভালো হয়ে যায়!
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘অন্যকোনো ভালো, আরও ভালো ডিজাইনের স্ট্যাম্প আছে স্যার?’
নিরাশ ভঙ্গিতে নাকের ওপর ঝুলে থাকা চশমার ফাঁক দিয়ে মাথা উচু না করেই পোস্টমাস্টার বললো,
‘ওই তো হলো। ওটা লাগালেই সঠিক জায়গায় চলে যাবে। একটুও নড়চড় হবে না। শুধু ঠিকানাটা ঠিক থাকলেই চলবে।’
তবুও মনটা চাইছে একটা শাপলা ফুল কোনো স্তব্ধ লেকে ভেসে আছে বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো শিশির গালে নিয়ে, এ রকম ছবিওয়ালা একটা ডাকটিকিট। নয়তো একটা সাদা ধবধবে বলাকা গলাটা একদম সামনে বাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে, যেন দূর থেকে, অনেক ওপর থেকে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে, এ রকম একটা স্ট্যাম্প পেলে ভালো হতো। বললাম,
‘তবুও দেখুন না একটু স্যার।’
আমার আকুতি হয়তো সে বুঝতে পারল। বললো, ‘এই যে দ্যাখো। আর এই এক রকম আছে। একটা খালি গায়ে গাড়ীয়াল, তার কাঁদায় আটকে থাকা গরুর গাড়ির চাকা ধরে ঠেলে কাদা থেকে গাড়িটাকে সামনে আগানোর চেষ্টা করছে।’
বলেই শুধু হাত গলানো যায় এ রকম জং ধরা লোহার গ্রিলের ফুঁকো দিয়ে একটা স্ট্যাম্প এগিয়ে দিলো আমার সামনে। বললাম,
‘হয়েছে, বেশ পছন্দ হয়েছে।’
এমআরএম/জেআইএম