ফ্রান্সের লিওতে অভিভাবকবিহীন তরুণ অভিবাসীদের মানবেতর জীবন
ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শহর লিওতে অন্তত ২৫০ জন অভিভাবকবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসী জানুয়ারি থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একটি অস্থায়ী শিবিরে কোনোমতে বসবাস করছেন। অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় করা আপিলের রায় এখনও না আসায় তারা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তারা।
সম্প্রতি ফ্রান্সে টানা কয়েক রাত ধরে তাপমাত্রা থাকছে হিমাঙ্কের নিচে। এমন বাস্তবতায় কয়েক ডজন তরুণ আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় একটি গির্জায়।
সম্প্রতি তাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস। বুধবার (১২ ডিসেম্বর) লিও শহরের ক্রোয়া-রুস এলাকার সাঁ-পলিকার্প গির্জায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করছিলেন এসব তরুণ। কেউ কম্বল নিচ্ছেন, কেউ ম্যাট্রেস সংগ্রহ করছিলেন। এরপর নীরবে গির্জার ভেতরের পথঘাটে শুয়ে পড়েন তারা। কম্বলে ঢাকা এক তরুণকে গির্জার একটি কক্ষের পাশে ঘুমাতে দেখা যায়।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে, বিশেষ করে চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যাওয়ায় প্রতি রাতেই একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
তাদের সবাই নিজেদের অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে দাবি করছেন। এমন ৬০ থেকে ৯০ জন তরুণ প্রতিদিন রাতে শার্ত্রু বাগানের অস্থায়ী শিবির ছেড়ে গির্জাটিতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
গির্জার একটি প্রার্থনার বেঞ্চে বসে আছেন ইব্রাহিম। ডান হাতে লাল রঙের কফির গ্লাস। চারপাশে ১৭শ শতকের বিশাল স্থাপত্যের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কালো ও নীল রঙের টুপি পরা ১৬ বছর বয়সি এই মালিয়ান তরুণ ইতোমধ্যে কয়েক রাত এখানে কাটিয়েছেন।
তিনি বলেন, সবকিছু নিখুঁত নয়, তবে খোলা রাস্তায় ঘুমানোর চেয়ে অনেক ভালো।
গির্জা কর্তৃপক্ষ তরুণদের আশ্রয়ের অনুমতি দিলেও কিছু নিয়ম আরোপ করেছে। ভবনের ভেতরে খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ। সন্ধ্যা ৬টার আগে প্রবেশ করা যাবে না এবং পরদিন সকাল ৯টার মধ্যে জায়গা পরিষ্কার করে বেরিয়ে যেতে হবে।
গির্জার সামনের চত্বরে বসে ক্ষাণিকটা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলার তরুণ জুনিয়র। ম্যাট্রেস ও কম্বল গুছিয়ে রেখে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেনন তিনি।
এখানে একটু ভালো লাগে। রাতটা এখানে বাইরে বা শিবিরের চেয়ে অনেক ভালো কাটে, বলেন তিনি।
প্রতিদিন ভোর ৬টায় উঠে কলেজে যান জুনিয়র, যেখানে তিনি পড়াশোনা করছেন। তবে আশ্রয় মিললেও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না তাদের। অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রথম আবেদন বাতিল হওয়ার পর তারা আপিল করেছেন। এখন শিশু আদালতের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।
‘আমরা এখানে বেশি দিন থাকতে পারব না। একদিন নিরাপদ আশ্রয় পাব এই আশাই করছি,’ বলেন জুনিয়র। তার মতোই প্রায় ২৫০ জন তরুণ আপিলের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে সবাই গির্জায় জায়গা পায়নি।
এসব তরুণদের বেশিরভাগই সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো থেকে এসেছেন। বিচারকের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত এ তরুণেরা না অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে, না প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। ফলে তারা শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় যেমন আসছে না, তেমনি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য থাকা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেও প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না।
এনজিও কর্মী সেদ্রিক বলেন, ‘তাদের পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করা হয়েছে।’
চার মাস ধরে আপিলের রায়ের অপেক্ষায় থাকা ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি আর রাস্তার অস্থায়ী শিবিরে ফিরতে চাই না। ওটা অমানবিক। আমরা ইঁদুরের সঙ্গে ঘুমাই। খাবার খুব কম। সেখানে গোসল করাও এক ধরনের যুদ্ধ।’
শিবিরের পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। পার্কের গ্রিলের পেছনে কাঠের প্যালেটের ওপর উঁচু করে বসানো সারি সারি তাঁবু। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ডিগ্রি উষ্ণতা ধরে রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে অনেক তাঁবু ঢেকে দেওয়া হয়েছে কম্বল দিয়ে। আর তাঁবুর ফাঁকে ফাঁকে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইঁদুর।
তিনি যোগ করেন, বৃষ্টির সময় অবস্থা আরও খারাপ হয়। চারদিকে পানি ঢোকে, তাঁবু ভিজে যায়, আমরা কাদার মধ্যে থাকি।
তার পাশেই থাকা প্রতিবেশী ড্রামেও একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনিও পড়াশোনা করছেন।
‘এই অবস্থায় কীভাবে এগোবো? এখানে থেকে কীভাবে স্কুলে ভালো করব?’-প্রশ্ন ছোঁড়ে দেন লাল জ্যাকেট পরা ড্রামে। মঙ্গলবার মুসলিম হ্যান্ডস নামের একটি সংস্থা শিবিরে গরম খাবার, ফল ও ডেজার্ট বিতরণ করেছে। ‘বাকি সময় কখন খাবার জুটবে, তা পুরোপুরি ভাগ্যের ওপর, বলেন আরেক তরুণ লাই।
‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’
কারও কারও অপেক্ষা জানুয়ারি থেকে প্রায় এক বছর। ফলে শিবিরে একধরনের দৈনন্দিন জীবন গড়ে উঠেছে। কোথাও অস্থায়ী আগুন জ্বালিয়ে গল্প করছেন কয়েকজন। অন্য পাশে এক তরুণ আয়না হাতে ধরে বন্ধুর চুল কাটছেন। বড় সাদা তাঁবুর নিচে, মেঝেতে পাতা কার্পেটের ওপর দুই তরুণ নামাজ পড়ছেন, যা কার্যত একটি অস্থায়ী মসজিদে রূপ নিয়েছে।
গত অক্টোবরে মেদসাঁ সঁ ফঁন্তিয়ের এবং ইতুপিয়া ৫৬ এখানে এসে পরিস্থিতিকে ‘মানবিক সংকট’ আখ্যা দেয় এবং শিবিরবাসীদের ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি’র বিষয়ে সতর্ক করে।
এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট মোকাবিলায় ‘লা স্তাসিওঁ’ নামে একটি কেন্দ্র চালু করেছে লো মাস নামের একটি সংস্থা। লিও মেট্রোপোল এবং প্রিফেকচারের সহায়তায় এটি খোলা হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এখানে আপিলরত ১০২ জন তরুণকে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
সংস্থাটির জরুরি বিভাগের প্রধান মারিয়ানে কলোভ্রে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘রায়ের আগ পর্যন্ত আমরা তাদের আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসংক্রান্ত সহায়তা দিই।’
২০২৫ সালের শেষদিকে মেয়রের উদ্যোগে আরও ৪০ শয্যার একটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ‘লা স্তাসিওঁয়ের মতো আরও জায়গা দরকার,’ দাবি অভিবাসী সহায়তা সংগঠনগুলোর।
নভেম্বরের শেষে, গির্জায় ঢোকার আগেই মেয়র ও প্রিফেকচারের সঙ্গে একটি বৈঠক হলেও ‘কোনো সমাধান আসেনি,’ বলেন সেদ্রিক।
লিও মেট্রোপোল ও প্রিফেকচার একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে। মেট্রোপোলের দাবি, বিচারকের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত এ তরুণরা ‘প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত’ এবং ‘রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত।’
অন্যদিকে প্রেফেকচুর জানায়, অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে দায়িত্ব মেট্রোপোলের, আর অনিয়মিত প্রাপ্তবয়স্ক হলে ফরাসি অভিবাসন ও একীভূতকরণ দপ্তর তাদের মূল্যায়ন করবে।
হতাশ সেদ্রিক বলেন, ‘সবাই শুধু দায় ঠেলে দিচ্ছে, একজন আরেকজনের দিকে।’
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস
এমআরএম/জেআইএম