যেভাবে মুসলমানদের খলিফা হন আবু বকর (রা.)

ওমর ফারুক ফেরদৌস
ওমর ফারুক ফেরদৌস ওমর ফারুক ফেরদৌস , আলেম ও লেখক
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ২৭ জুলাই ২০২৫
সংগৃহীত ছবি

আবু বকর (রা.) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অন্যতম প্রধান ও প্রিয় সাহাবি। ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি একজন। বলা হয় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন মক্কার সর্বজনপ্রিয় ও প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। আভিজাত্য, ভদ্রতা ও সুচরিত্রের জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেককেই ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ জোগায়।

ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচার প্রসারে আবু বকরের (রা.) ত্যাগ-তিতিক্ষা, আল্লাহর ইবাদত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তার অগ্রগামিতা তাকে মুসলমানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত করে। মুসলমানদের মধ্যে নবিজির (সা.) পরই ছিল তার অবস্থান। নবিজি (সা.) তাকে সাহাবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তার অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ওহাব আস-সুয়ায়ী থেকে বর্ণিত আলী (রা.) একদিন খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কি জানেন নবিজির (সা.) পর এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে? সবাই বললেন আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি বললেন, না, নবিজির (সা.) পর এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ওমর। (মুসনাদে আহমদ: ৮৩৪)

যেভাবে মুসলমানদের খলিফা হন আবু বকর (রা.)সংগৃহীত ছবি

ওফাতের আগে নবিজির (সা.) যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাকে নিজের জায়গায় নামাজের ইমামতির দায়িত্ব দেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ওফাতের আগে একদিন ইশার সময় নবিজি (সা.) খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববিতে ইশার নামাজের অপেক্ষায় ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি একে একে তিনবার ওঠার চেষ্টা করেন; কিন্তু তিনবারই বেহুঁশ হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরে পেলেই জিজ্ঞেস করতেন, সাহাবিরা ইশার নামাজ পড়েছে? আয়েশা (রা.) জবাব দিতেন, না, তারা তো আপনার অপেক্ষায় আছে। তৃতীয়বার জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি বললেন, আবু বকরকে নামাজ পড়াতে বলো।

আয়েশা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি কোমল হৃদয়ের মানুষ। আপনার জায়গায় নামাজে দাঁড়ালে তিনি হয়তো ঠিকমতো কেরাতও পড়তে পারবেন না। কিন্তু রাসুল (সা.) দুই বা তিনবার আবু বকরকেই (রা.) ইমামতির দায়িত্ব দিতে বললেন। (আসাহহুস সিয়ার)

এটা ছিল নবিজির (সা.) পক্ষ থেকে সাহাবায়ে কেরামের জন্য একটি ইশারা যে, নবিজির (সা.) পর হজরত আবু বকরই (রা.) তার খলিফা বা স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। কিন্তু নবিজি (সা.) মৃত্যুর আগে স্পষ্ট করে আবু বকরকে (রা.) খলিফা নির্ধারণ করেননি। পরবর্তী নেতা নির্বাচনের বিষয়টি তিনি তার সাহাবিদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

নবিজির (সা.) ইন্তেকালের পর মুসলমানদের নেতা কে হবেন এটা নিয়ে সাহাবিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আবু বকর (রা.) খলিফা হিসেবে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহের (রা.) নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু তারা দুজনই খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে আবু বকরকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন।

যেভাবে মুসলমানদের খলিফা হন আবু বকর (রা.)সংগৃহীত ছবি

আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) আবু বকরকে (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরে মুসলমানদের মধ্যে কারো জন্যই আপনার ওপরে স্থান পাওয়া সমীচীন নয়। আপনি সেই ব্যক্তি, যিনি রাসুলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে হিজরতের সময় সাওর গুহায় ছিলেন। কোরআনে আপনাকে ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অসুস্থ হলেন, তখন তিনি আপনাকেই ইমামতি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আপনি নামাজের ইমামতি করেছিলেন। সুতরাং এই দায়িত্বে আপনার হকই সবচেয়ে বেশি।

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সমবেত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কি জানেন না যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাজের জন্য আবু বকরকে সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন? তাহলে আমাদের মধ্যে কে এমন আছে যার মন সায় দেয় যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, সে তার চেয়েও সামনে এগিয়ে যাবে?

এভাবে সাহাবায়ে কেরাম একমত হন যে, আবু বকরেরই (রা.) খলিফা হওয়া উচিত। নবিজি (সা.) স্পষ্টভাবে তাকে খলিফা নির্ধারণ করে না গেলেও নামাজের ইমামতি করার নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

ওমর (রা.) প্রথম আবু বকরকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করে তার হাতে বায়াত হন (অর্থাৎ তার আনুগত্যের শপথ করেন)। তারপর একে একে উল্লেখযোগ্য সাহাবায়ে কেরাম এবং মদিনার সাধারণ মুসলমানরা আবু বকরের (রা.) হাতে বায়াত হন।

খলিফা হয়ে প্রথম ভাষণে আবু বকর (রা.) বলেন,

"হে মানুষ! আমাকে আপনাদের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম নই। আমি যদি সঠিক পথে থাকি, তাহলে আমাকে সাহায্য করুন। যদি ভুল পথে থাকি, তাহলে আমাকে সংশোধন করে দিন। আমি যতক্ষণ আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলব, ততক্ষণ আমার আনুগত্য করুন। যদি আল্লাহর অবাধ্য হই, তাহলে আমার আনুগত্য করার প্রয়োজন নেই। শুনে রাখুন! আপনাদের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার হক আদায় করে দিতে পারি। আর আপনাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি আমার কাছে দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে হক আদায় করে নিই। আল্লাহর কাছে আমার ও আপনাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

ওএফএফ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।