আল্লাহর প্রেমের সাধক রাবেয়া বসরী

ওমর ফারুক ফেরদৌস
ওমর ফারুক ফেরদৌস ওমর ফারুক ফেরদৌস , আলেম ও লেখক
প্রকাশিত: ০৭:৩৮ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৫
রাবেয়া বসরীর জীবনী। ছবি: ক্যানভা

রাবেয়া বসরী কে ছিলেন?

রাবেয়া বসরী (রহ.) ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সাধক যিনি তার পুরো জীবন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, নিজেকে জাগতিক সব রকম বিলাস ও আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে রেখেছিলেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে রচিত কবিতার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।

রাবেয়া বসরীর জন্ম ও বংশপরিচয়

রাবেয়া বসরির বাবার নাম ইসমাইল। তিনি ছিলেন বনু আদাওয়াহ গোত্রের সন্তান। তিনি ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে (তার জন্মতারিখ নিয়ে মতান্তর রয়েছে) বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। বসরার দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে ‘রাবেয়া বসরী’ এবং বনু আদাওয়াহ গোত্রের দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে ‘রাবেয়া আদাওয়িয়া’ও বলা হয়। তার নাম ‘রাবেয়া’ (অর্থাৎ চতুর্থ) রাখা হয়েছিল কারণ তিনি তার বোনদের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন।

রাবেয়া বসরীর শৈশব ও জীবনসংগ্রাম

রাবেয়া অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং দশ বছর বয়সের আগেই তার বাবাকে হারান। এর কিছুদিন পর তার মাও মারা যান। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর রাবেয়া বসরী এবং তার বোনেরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন। তাদের বাবা-মা কেবল একটি নৌকা রেখে গিয়েছিলেন যা দিয়ে লোক পারাপার করে কিছু অর্থ আয় করা যেত। রাবেয়া তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সেই নৌকা চালিয়ে নিজের এবং তার বোনদের ভরণপোষণের চেষ্টা করেন।

সেই কঠিন সময়ে তারা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন এবং রাবেয়া বোনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কিছুদিন তিনি ভবঘুরের মত জীবন কাটান। এক পর্যায়ে বসরার এক চোর তাকে অপহরণ করে ছয় দিরহামের বিনিময়ে এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়।

রাবেয়া বসরী ওই ব্যবসায়ীর দাসত্বে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিনগুলো কাটান। ব্যবসায়ী তাকে তার আয়োজিত আসরগুলোতে বাঁশি বাজাতে বাধ্য করতো। রাবেয়া বাঁশি বাজাতেন বটে, কিন্তু এই কাজ তিনি অপছন্দ করতেন এবং অবসর পেলেই আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও মুরাকাবায় মগ্ন হয়ে যেতেন।

একদিন রাবেয়া বসরীর মনিব ব্যবসায়ী রাবেয়াকে গোপনে আল্লাহর তাআলার কাছে দোয়া করতে শোনেন। তিনি দোয়া করছিলেন, আল্লাহ তাআলা যেন তাকে দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি দেন। এই দোয়া শুনে রাবেয়ার মনিবের মনে দয়া হয় এবং তিনি রাবেয়াকে মুক্ত করে দেন।

দাসত্বের জীবন থেকে মুক্ত হয়ে রাবেয়া বসরী নিজেকে আল্লাহর ইবাদতে উৎসর্গ করেন, বিয়ে ও সন্তান ধারণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। আমৃত্যু তিনি বিয়েহীন ছিলেন।

রাবেয়া বসরীর আল্লাহপ্রেম

রাবেয়া বসরীকে ‘শহীদাতুল ইশকিল ইলাহী’ অর্থাৎ ঐশ্বরিক প্রেমের শহীদ এবং ‘সাইয়েদাতুল আশেকিন’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রেমিকদের সম্রাজ্ঞী বলা হয়। তাকে ‘উম্মুল খাইর’ অর্থাৎ কল্যাণের জননীও বলা হয়।

রাবেয়া বসরী আল্লাহকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তিনি সুফিবাদের অনুসারী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, আল্লাহর ইবাদত করা উচিত শুধু তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য, জান্নাত লাভের জন্য বা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য নয়।

রাবেয়া বসরী অল্প বয়সেই কোরআন মুখস্থ করেছিলেন। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি নামাজ ও ইবাদতে কাটাতেন। তার সেবিকা আবদা বিনতে আবি শাওয়াল তাঁর সম্পর্কে বলেন, রাবেয়া প্রতিদিন শত শত রাকাত নামাজ পড়তেন। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করত, আপনি এত কিছুর বিনিময়ে কী চান? তিনি বলতেন, আমি কোনো পুরস্কার চাই না, শুধু চাই আল্লাহর রাসুল (সা.) যেন খুশি হন, যেন তিনি তার অন্যান্য নবী ভাইদের কাছে বলতে পারেন, দেখুন, এ আমার উম্মতের একজন নারী, আর এই হলো তার আমল।

রাবেয়া বসরীর কবিতা

রাবেয়া বসরী কবি হিসেবেও প্রসিদ্ধ। তিনি আল্লাহর প্রেমের কবিতা লিখতেন। এখানে তার রচিত একটি আরবি কবিতার ভাবানুবাদ উল্লেখ করলাম:

তোমাকে ভালোবেসেই চিনেছি প্রেম

এবং তুমি ছাড়া সবার জন্য হৃদয়ের দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।

আমি তোমার সাথে নিভৃতে কথা বলতাম, হে সেই সত্তা যিনি দেখেন

হৃদয়ের গোপন কথাও যদিও আমরা তোমাকে দেখতে পাই না।

আমার প্রেম দুই ধরনের; প্রবৃত্তির প্রেম

আর প্রকৃত প্রেম যা পাওয়ার উপযুক্ত শুধু তুমি।

আর আমার প্রবৃত্তির প্রেম হলো

তোমার স্মরণে মগ্ন হয়ে সবাইকে ত্যাগ করা।

আর যে প্রেম তোমার যোগ্য, তা হলো

পর্দা উন্মোচন করে তোমাকে দেখতে পাওয়া।

রাবেয়া বসরীর মৃত্যু

রাবেয়া বসরীর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন ১৮০ হিজরি (৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ), আবার কেউ বলেন ১৮৫ হিজরি (৮০১ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি প্রায় ৮০ বছর বয়সে মারা যান। কেউ কেউ বলেন তাকে জেরুজালেমে দাফন করা হয়েছে, কিন্তু তার শাম (সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চল) বা জেরুজালেমে ভ্রমণের কোনো প্রমাণ নেই। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুসারে বসরার কাছেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

সূত্র: মাওযু ডট কম

ওএফএফ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।