ইসলামের ইতিহাসে প্রথম হিজরত

ওমর ফারুক ফেরদৌস
ওমর ফারুক ফেরদৌস ওমর ফারুক ফেরদৌস , আলেম ও লেখক
প্রকাশিত: ০৫:৪৮ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত

মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার পর মক্কার মুশরিক নেতারা নবিজি (সা.) ও ইসলামি দাওয়াতের শত্রু হয়ে যায়। ইসলামকে নিজেদের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করে তারা ইসলামের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর চেষ্টা করে। শুরুতে তাদের বিরোধিতা কিছুটা সহনশীল ছিল, কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছিল, মক্কায় মুসলমানদের সংখ্যা যত বাড়ছিল, মুশরিক নেতারা ইসলামের বিরোধিতায় আরও বেশি কঠোর হয়ে উঠছিল। মুসলমানদের ওপর ইসলাম ত্যাগের চাপ ও নির্যাতন বাড়ছিল।

এক পর্যায়ে মক্কার মুসলমানরা মক্কা ত্যাগ করার কথা ভাবতে থাকেন। তারা এমন একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকেন যেখানে তারা মুশরিকদের নির্যাতন ও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন।

সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা সুরা কাহাফ নাজিল করেন। এ সুরায় বর্ণিত হয়েছে কিছু ইমানদার তরুণের কাহিনি, যারা ইমান নিয়ে ওই সময়ের এক জালিম রাজার জুলুম থেকে পালিয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই কাহিনি ছিল মুমিনদের জন্য সান্ত্বনা, এবং তাদের পথনির্দেশনা যে, কোন পথ অবলম্বন করলে তারা সেই দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

গুহাবাসী যুবকদের কাহিনিতে তুলে ধরা হয়েছিল কীভাবে প্রকৃত ইমানদাররা দুনিয়ার চাকচিক্য ও ভোগবিলাসের ওপর ইমান ও হেদায়াতের পথকে প্রাধান্য দিয়েছিল এবং কীভাবে আল্লাহ তাআলা তাদের নিরাপত্তা দেন, ফেতনা থেকে বাঁচান এবং নিজের রহমত ও করুণায় আচ্ছাদিত করেন। যেমন ওই সুরায় আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা যখন তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর; তোমাদের রব তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের কর্মসমূহকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন। (সুরা কাহাফ: ১৬)

এই কাহিনি মুমিনদের সামনে সত্য ও মিথ্যার পথ সুস্পষ্ট করে দেয় এবং জানিয়ে দেয়—দুটির মধ্যে কোনো অবস্থাতেই মিলন সম্ভব নয়। বরং মুমিনদের সামনের পথ হলো মোকাবেলা ও প্রয়োজনে নিজের ইমান নিয়ে হিজরত। আর এ কোরআনিক দিকনির্দেশ থেকেই নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মজলুম সাহাবিদের হাবশায় হিজরত করার নির্দেশ দেন।

এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালমা (রা.)। তিনি বলেন, এক পর্যায়ে মক্কা আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেল। নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিরা নির্যাতিত হচ্ছিলেন এবং চোখের সামনে নিজের সঙ্গীদের নির্যাতিত হতে দেখেও নবিজি (সা.) তাদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। নবিজি (সা.) নিজে তার গোত্র ও চাচার সুরক্ষায় ছিলেন। তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা সহজ ছিল না। কিন্তু নবিজির (সা.) অনেক সাহাবি নিজেদের রক্ষা করতে পারছিলেন না। তখন নবিজি (সা.) তাদের বললেন, হাবশার ভূমিতে এমন একজন বাদশাহ আছেন, যার শাসনাধীন অঞ্চলে কারো প্রতি অবিচার করা হয় না। তোমরা তার দেশে চলে যাও, যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের জন্য মুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং এখানকার পরিস্থিতি সহজ করে দেন। তখন আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হাবশার দিকে রওয়ানা দিলাম এবং হাবশায় পৌঁছে একত্রিত হলাম। আমরা সেখানে সর্বোত্তম আশ্রয় পেলাম, দ্বীন পালনের ব্যাপারে আমরা সেখানে নিরাপদ ছিলাম এবং তার পক্ষ থেকে কোনো অন্যায় আচরণের মুখোমুখি হইনি। (বায়হাকি)

কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা হিজরত করেছে আল্লাহর রাস্তায় অত্যাচারিত হওয়ার পর, আমি অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়াতে উত্তম আবাস দান করব। আর আখিরাতের প্রতিদান তো বিশাল, যদি তারা জানত। (সুরা নাহল: ৪১)

প্রখ্যাত মুফাসসির কাতাদা (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ আয়াতে নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিদের উদ্দেশ্য করা হয়েছে। মুশরিকরা তাদের মক্কায় জুলুম করেছে এবং তাদেরকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। তাদের একটি দল হাবশায় চলে গিয়েছিল। তারপর আল্লাহ তাআলা তাদের হিজরতের ভূমি দান করেছেন এবং তাদের জন্য মদিনার ইমানদারদের সাহায্যকারী বানিয়ে দিয়েছেন।

সাহাবিদের হিজরতে উদ্বুদ্ধ করার কয়েকটি কারণ ছিল। এর মধ্যে অন্যতম—তারা মুশরিকদের হাতে তীব্র নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মুশরিকরা সাহাবিদের ধর্ম থেকে ফিরিয়ে আনতে নানা রকম নির্যাতনের কৌশল ব্যবহার করেছিল। মক্কার বাইরে ইসলামি দাওয়াতের বিস্তার এবং মুসলমানদের একটি নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তোলাও ছিল হিজরতের আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য।

হিজরতের প্রথম কাফেলা হাবশার দিকে রওনা হয় নবুয়্যতের পঞ্চম বছর। এ কাফেলায় ছিলেন বারো জন পুরুষ ও চার জন নারী সাহাবি। এই কাফেলায় ওসমান ইবনে আফফান (রা.) এবং তার স্ত্রী রাসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা রুকাইয়াও (রা.) ছিলেন। তারা গোপনে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করেন যেন মক্কার মুশরিকরা টের না পায়। জেদ্দার সমুদ্রবন্দরে পৌঁছে তারা সেখানে দুটি বাণিজ্যিক জাহাজ পান, যা তাদের নিয়ে হাবশার উদ্দেশ্যে রওনা করে। মুশরিকরা তাদের হাবশার দিকে রওয়ানা হওয়ার খবর জানতে পেরে তখন তাদের ধরে আনার জন্য লোক পাঠায়। কিন্তু তারা উপকূলে পৌঁছার আগেই জাহাজ সাহাবিদের নিয়ে হাবশার পথে রওয়ানা হয়।

হাবশায় পৌঁছে সাহাবিরা নিরাপত্তা লাভ করেন, বাদশাহ নাজাশির পক্ষ থেকে সম্মান ও আতিথ্য লাভ করেন—যেমন নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, তার শাসনাধীন অঞ্চলে কারো প্রতি অবিচার করা হয় না।

সূত্র: ইসলাম ওয়েব

ওএফএফ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।