আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহশীল
![আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহশীল](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/quran-20220824201837.jpg)
আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ওহুদের যুদ্ধে সাময়িক পরাজয় ও এর কারণ উল্লেখ করেছেন। সে সময়ের অবস্থা উল্লেখ করেছেন। সর্বোপরি মহান রাব্বুল আলামিন মুমিনদের উপর অনুগ্রহশীল বলে এভাবে ঘোষণা দেন-
وَ لَقَدۡ صَدَقَکُمُ اللّٰهُ وَعۡدَهٗۤ اِذۡ تَحُسُّوۡنَهُمۡ بِاِذۡنِهٖ ۚ حَتّٰۤی اِذَا فَشِلۡتُمۡ وَ تَنَازَعۡتُمۡ فِی الۡاَمۡرِ وَ عَصَیۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَاۤ اَرٰىکُمۡ مَّا تُحِبُّوۡنَ ؕ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الدُّنۡیَا وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرِیۡدُ الۡاٰخِرَۃَ ۚ ثُمَّ صَرَفَکُمۡ عَنۡهُمۡ لِیَبۡتَلِیَکُمۡ ۚ وَ لَقَدۡ عَفَا عَنۡکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ ذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘আর আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন, যখন তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশক্রমে হত্যা করছিলে। অবশেষে যখন তোমরা সাহস হারিয়েছিলে এবং (রাসুলের) নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করেছিলে এবং যা তোমরা পছন্দ করো, তা (বিজয়) তোমাদেরকে দেখানোর পরে তোমরা অবাধ্য হয়েছিলে (তখন বিজয় রহিত হলো)। তোমাদের কিছু লোক ইহকাল কামনা করেছিল এবং কিছু লোক পরকাল কামনা করেছিল। এরপর তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তিনি তোমাদেরকে তাদের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন। তবুও (কিন্তু) তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহশীল।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৫২)
আয়াতের সার-সংক্ষেপ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় (সাহায্যের) অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করে দেখালেন। যখন তোমরা (যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় তাঁর আদেশে অবিশ্বাসীদের হত্যা করছিলে (তোমাদের এ চাপ আস্তে আস্তে বেড়েই চলতো) যে পর্যন্ত না তোমরা নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়তো এভাবে যে, পেছনের রক্ষাব্যূহে ৫০জন সৈন্য ও অধিনায়ক নিযুক্ত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আদেশ করেছিলেন, তোমরা ভুল বোঝাবুঝিবশত তাতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লে। কেউ কেউ মনে করেছিল যে, আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েগেছে। কাজেই এখানে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। শত্রুদের মোকাবেলা সবার সঙ্গে অংশগ্রহণ করা উচিত। পরস্পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের ব্যাপারে মতোবিরোধ করতে লাগলো। কেউ সেখানে অবস্থানের উপর অটল ছিল; কেউ কেউ অন্য প্রস্তাব উত্থাপন করলো। এ অন্য প্রস্তাবের কারণেই ভর্ৎসনা করা হয়েছিল যে, তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথামতো চললে না। তোমাদের মনোবাঞ্ছনা চোখের সামনে দেখিয়ে দেওয়ার পর অর্থাৎ মুসলমানদের বিজয় দেখানো হয়েছিল। তখন তোমাদের অবস্থা ছিল এই যে, তোমাদের কেউ দুনিয়ার সামগ্রী কামনা করছিলে। শত্রু সৈন্য হটিয়ে দিয়ে গনিমতের মাল আহরণ করতে চেয়েছিল। এবং কেউ কেউ শুধু পরকালের কামনা করেছিল।
কিছু সংখ্যক মুসলমানের পক্ষ থেকে অভিমতের দুর্বলতা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের বিপরীতে ভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করা, তাঁর কথা মতো না চলা, দুনিয়ার সামগ্রী কামনা করা ইত্যাদি পাপসমূহ প্রকাশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যতের সাহায্য বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া থেকে তোমাদের বিরত রাখেন। যদিও এ সাময়িক পরাজয় তোমাদের কর্মেরই ফল, তথাপিও এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সাজা হিসেবে নয় বরং এ কারণে হয়, যাতে আল্লাহ তাআলা তোমাদের ঈমান পরীক্ষা করতে পারেন।
এ সময়ই কপট বিশ্বাসী মুসলমানদের কপটতা ফুটে ওঠে এবং খাঁটি মুসলমানদের মূল্য বেড়ে যায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ক্ষমা করেছেন। এ জন্য পরকালে তোমাদের শাস্তি দেওয়া হবে না। আর আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি খুবই অনুগ্রহশীল।’ (মারেফুল কোরআন)
আলোচ্য আয়াতের বিষয়গুলো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছেন এভাবে-
হজরত বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহুদের যুদ্ধে পঞ্চাশ জনের এক দল সাহাবিকে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে দিয়ে বললেন, যদি তোমরা দেখ যে, পাখি আমাদেরকে ছুঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে তাতেও তোমরা তোমাদের স্থান ত্যাগ করে যাবে না। যতক্ষন না আমি তোমাদেরকে ডেকে পাঠাই। অনুরূপভাবে যদি তোমরা দেখ যে, আমরা শক্রদের পর্যুদস্ত করে দিয়েছি তাতেও তোমরা স্থান ত্যাগ করবে না যতক্ষণ আমি তোমাদের ডেকে না পাঠাই। তারপর মুসলিমগণ কাফেরদের পরাজিত করলো। বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি মহিলাদের চুড়ি, পায়ের গোড়ালি ইত্যাদিও দেখছিলাম, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের সাথীগণ বলতে আরম্ভ করলো গনিমতের মাল এসে পড়েছে, তোমাদের সাথীরা কাফেরদের উপর জয়লাভ করেছে, সুতরাং তোমরা কিসের অপেক্ষা করছো?
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে বললেন, তোমরা কি রাসুলের নির্দেশ ভুলে গেছ? তারা বলল, আমরা মানুষের কাছে গিয়ে গনিমতের মাল জমা করবো। একথা বলে তারা স্থান ত্যাগ করতে আরম্ভ করলো। আর এতেই যুদ্ধের পট পরিবর্তিত হয়ে গেল। জয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল। সবাই পালাতে আরম্ভ করলো। রাসুলের সঙ্গে মাত্র বার জন লোক ছিল। রাসুল তাদেরকে ডাকতে থাকলেন। এভাবে মুসলিমদের সত্তর জন লোক শহিদ হয়ে গেল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাথীরা বদরের দিন একশত চল্লিশ জন কাফেরকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিলেন, তাদের সত্তর জন মারা যায় আর বাকী সত্তর জন আহত হয়ে বন্দী হয়। তখন আবু সুফিয়ান তিন বার বললো, এখানে কি মুহাম্মাদ আছে? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে উত্তর দিতে নিষেধ করলেন। তারপর আবু সুফিয়ান তিন বার বললো, এখানে কি ইবনে আবি কুহাফা আছে? তারপর আবু সুফিয়ান তিনবার বললো, এখানে কি ইবনুল খাত্তাব আছে? তারপর সে তার সাথীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, এরা সবাই মারা পড়েছে। তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। তিনি বলে বসলেন, হে আল্লাহর দুশমন! তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি যাদের কথা বলেছ তারা সবাই জীবিত। আর তোমার যাতে খারাপ লাগে তা অবশ্যই বাকী আছে।
তখন আবু সুফিয়ান বলে বসলো, বদরের দিনের বদলে একটি দিন হলো আজ। আর যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। তুমি তোমাদের মৃতদের মাঝে কিছু বিকৃত লাশ দেখতে পাবে। আমি বিকৃত করার নির্দেশ দেইনি। কিন্তু আমার খারাপও লাগেনি। তারপর সে আবৃতি করতে লাগলো, হুবলের জয় হোক, হুবলের জয় হোক। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কি তার জবাব দেবে না? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি বলবো? তিনি বললেন, ‘তোমরা বল, আল্লাহ মহান ও সর্বোচ্চ। তখন আবু সুফিয়ান বললো, আমাদের উযযা আছে তোমাদের উযযা নেই। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা জবাব দেবে না? সাহাবগণ বললেন, কী জবাব দেবো? তিনি বললেন, তোমরা বল যে, আল্লাহ্ আমাদের অভিভাবক-সাহায্যকারী, তোমাদের কোনো অভিভাবক-সাহায্যকারী নেই।’ (বুখারি)
আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের কর্মে ত্রুটি ও অবহেলা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁদেরকে যে মর্যাদা-সম্মান দান করেছেন, সে কথাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁরা যাতে ভবিষ্যতে আর ভুল না করেন। তাই মহান আল্লাহ তাঁদের ভুলের কথা উল্লেখ করে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন। যাতে মন্দ অন্তরের লোকেরা তাঁদের ব্যাপারে কোনো কটূক্তি না করতে পারে। কারণ, মহান আল্লাহই যখন কোরআনুল কারিমে তাঁদের ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তখন অন্যের কি এ ব্যাপারে আর কোন নিন্দাপূর্ণ বাক্য ব্যবহার ও কটূক্তি করার অবকাশ থাকে?
কোনো এক হজ্জের সময় এক ব্যক্তি উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপন করলো। যেমন, তিনি বদর যুদ্ধে এবং বায়আতে রিদওয়ানে শরিক হননি এবং ওহুদের যুদ্ধে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই অভিযোগ খন্ডন করে বললেন, বদর যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা) অসুস্থ ছিলেন। বায়আতে রিদওয়ানে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর দূত হয়ে মক্কায় গিয়েছিলেন এবং ওহুদের দিনে পালিয়ে যাওয়াকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (বুখারি)
এ হাদিস ও ঘটনা থেকেই প্রমাণিত যে, মহান আল্লাহ মুমিনদের প্রতি কতবেশি অনুগ্রশীল। সুতরাং অন্যায় অপরাধ যতবেশিই হোক না কেন, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবা-ইসতেগফার করা থেকে বিরত থাকা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনুল কারিমের এ আয়াত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তার অনুগ্রহ পাওয়ার চেষ্টা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস