তারাবিহের আলোচনা

বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের সেবা ও দোয়া

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০২ পিএম, ০৩ এপ্রিল ২০২৩

১৪৪৪ হিজরির রমজান মাসের ১২তম তারাবিহ আজ। সুরা বনি ইসরাইল ও সুরা কাহাফের ৭৪ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে আজ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুরু হবে আজকের তারাবিহ। আজকের তারাবিহতে বাবা-মার জন্য দোয়াসহ রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া।

দ্বিতীয় দশকের দ্বিতীয় রোজার প্রস্তুতিতে তারাবিহ পড়বেন মুমিন মুসলমান। ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্বনবির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় মেরাজ। এটি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অনেক বড় মুজিজাও এটি। কুরআনুল কারিমে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ

‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে (সে রাতে) আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা ইসরা : আয়াত ১)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত লাভের ১১তম বছরের কোনো এক রাতে মেরাজ সংঘঠিত হয়েছিল। অনেকে ২৬ রজব দিবাগত রাতের কথা বলে থাকেন। তৎকালিন সময়ে তা ছিল সৃষ্টিজগতের সেরা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা।

মেরাজের আশ্চর্যজনক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা-বিশ্বাসের অংশও বটে। মেজারে ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। বিশ্বনবির মেরাজ নিয়ে আছে হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। মেরাজের রাতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ করেছিলেন। সেখান থেকে উর্ধ্ব আকাশের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন। মসজিদে হারাম ও বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে নবিজি বলেন-

হজরত আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। এরপর আমি আরয করলাম- এরপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম- এতদুভয়ের নির্মাণের মধ্যে কতদিনের ব্যবধান রয়েছে? তিনি বললেন- চল্লিশ বছর। তিনি আরও বললেনঃ এ তো হচ্ছে মসজিদদ্বয়ের নির্মাণক্রম। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা আমাদের জন্য সমগ্ৰ ভূ-পৃষ্ঠকেই মসজিদ করে দিয়েছেন। যেখানে নামাযের সময় হয়, সেখানেই সালাত পড়ে নাও। (মুসলিম ৫২০)

মেরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা

ইমাম ইবনে কাসির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার তাফসির গ্রন্থে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর এবং সংশ্লিষ্ট হাদিসসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করার পর বলেন, সত্য কথা এই যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসরা সফর জাগ্রত অবস্থায় করেন; স্বপ্নে নয়। মক্কা মোকাররমা থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত এ সফর বোরাকযোগে করেন। তারপরের সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলো, বায়তুল-মোকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোরাকটি অদূরে বেঁধে দেন এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মসজিদে প্রবেশ করেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে দুরাকাত নামাজ আদায় করেন। এরপর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নীচ থেকে উপরে যাওয়ার জন্য ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে প্রথমে প্রথম আসমানে, তারপর অবশিষ্ট আসমানসমূহে গমন করেন। এ সিঁড়িটি কি এবং কিরূপ ছিল, তার প্রকৃতস্বরূপ আল্লাহ্ তাআলাই জানেন।

প্রত্যেক আসমানে সেখানকার ফেরেশতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং প্রত্যেক আসমানে সে সমস্ত নবি-রাসুলদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়, যাদের অবস্থান কোনো নির্দিষ্ট আসমানে রয়েছে। যেমন- ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারপর তিনি পয়গম্বরগণের স্থানসমূহও অতিক্রম করে এবং এক ময়দানে পৌছেন, যেখানে তাকদির লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তিনি ‘সিদরাতুল-মুনতাহা’ দেখেন। যেখানে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙ এর প্ৰজাপতি ইতস্তত ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরিল আলাইহিস সালামকে তাঁর স্বরূপে দেখেন। তাঁর ছয়শত পাখা ছিল। তিনি বায়তুল-মামুরও দেখেন।

বায়তুল মামুরের কাছেই কাবার প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম প্রাচীরের সাথে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এই বায়তুল মামুরে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে। কেয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনরায় প্রবেশ করার পালা আসবে না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। সে সময় তার উম্মতের জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। তারপর তা হ্রাস করে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়। এ দ্বারা ইবাদতের মধ্যে নামাজের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। এরপর তিনি বায়তুল মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আসমানে যেসব পয়গম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল তারাও তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাবার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত আগমন করেন। তখন নামাজের সময় হয়ে যায় এবং তিনি পয়গম্বরগণের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। সেটা সেদিনকার ফজরের নামাজেও হতে পারে।

ইবনে কাসির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, নামাজে পয়গম্বরগণের ইমাম হওয়ার এ ঘটনাটি কারও মতে আসমানে যাওয়ার আগে সংঘটিত হয়। কিন্তু বাহ্যত এ ঘটনাটি প্রত্যাবর্তনের পর ঘটে। কেননা আসমানে নবি রাসুলগণের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনায় একথাও বর্ণিত রয়েছে যে, জিবরিল আলাইহিস সালাম সব পয়গম্বরগণের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। ইমামতির ঘটনা প্ৰথমে হয়ে থাকলে এখানে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।

এছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল উর্ধ্ব জগতে গমন করা। কাজেই একাজটি প্রথমে সেরে নেয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আসল কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর সব পয়গম্বর বিদায় দানের জন্যে তার সাথে বায়তুল-মোকাদ্দাস পর্যন্ত আসেন এবং জিবরিল আলাইহিস সালামের ইঙ্গিতে তাকে সবাই ইমাম বানিয়ে কার্যত তার নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেওয়া হয়। এরপর তিনি বায়তুল মোকাদ্দেস থেকে বিদায় নেন এবং বোরাক সওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কা মোকার্‌রমা পৌঁছে যান।

হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, মেরাজের ব্যাপারে কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা প্ৰতিপন্ন করতে চেষ্টা করল তখন আমি কাবার হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আর আল্লাহ বাইতুল মাকদিসকে আমার সামনে উদ্ভাসিত করলেন। ফলে আমি তার দিকে তাকিয়ে তার চিহ্ন ও নিদর্শনগুলো তাদেরকে বলে দিতে থাকলাম।’ (বুখারি ৩৮৮৬)

সুরা বনি ইসরাঈল (১-১১১)

সুরা বনি ইসরাইল পবিত্র নগরী মক্কায় নাজিল হয়। সুরাটি ১২ রুকু ও ১১১ আয়াতে সন্নিবেশিত। যদিও সুরার নাম বনি ইসরাইল কিন্তু বনি ইসরাইল এ সুরার আলোচ্য বিষয় নয়। বরং প্রতীকী হিসেবে নামটি সুরার চার নম্বর আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে। এ সুরার প্রথম আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সুরাটি মিরাজের সময় নাজিল হয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হিজরতের এক বছর পূর্বে এ সুরাটি নাজিল।

সুরাটি মুসলি উম্মাহর জন্য সতর্কবার্তা। মক্কার কাফের অবিশ্বাসীদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, বনি ইসরাইল ও অন্যান্য জাতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহর দেয়া অবকাশ তথা সময় শেষ হয়ে আসছে তা শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের সামলে নাও।

মানুষকে সৎ পথে চলার জন্য নসিহত করা হয়েছে। আবার ভালো মন্দ কাজের যার যার আমলনামা তাকেই পড়তে হবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِقۡرَاۡ کِتٰبَکَ ؕ کَفٰی بِنَفۡسِکَ الۡیَوۡمَ عَلَیۡکَ حَسِیۡبًا

'পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব (আমল)। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট।' (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ১৪)

হজরত হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, যিনি তোমার হিসাবের ভার তোমার কাছেই অৰ্পণ করেছেন তিনি অবশ্যই তোমার সঙ্গে সবচেয়ে বড় ইনসাফের কাজ করেছেন।’ (ইবনে কাসির)

হজরত কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সেদিন সবাই তাদের আমলনামা পড়তে পারবে। যদিও সে দুনিয়াতে নিরক্ষর ছিল।’ (তাবারি)

مَنِ اهۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَهۡتَدِیۡ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡهَا ؕ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ وَ مَا کُنَّا مُعَذِّبِیۡنَ حَتّٰی نَبۡعَثَ رَسُوۡلًا

'যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১৫)

বাবা-মায়ের খেদমত ও দোয়া

এ সুরায় আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে পিতামাতার প্রতি উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবার পিতামাতার জন্য দোয়া শেখানো হয়েছে এ সুরায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ قَضٰی رَبُّکَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ؕ اِمَّا یَبۡلُغَنَّ عِنۡدَکَ الۡکِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ کِلٰهُمَا فَلَا تَقُلۡ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنۡهَرۡهُمَا وَ قُلۡ لَّهُمَا قَوۡلًا کَرِیۡمًا

'তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে `উহ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৩)

'তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল-

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

উচ্চারণ : 'রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা'

অর্থ : 'হে আমার প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৪)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বাবা-মায়ের আদব, সম্মান এবং তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সঙ্গে একত্রিত করে ফরয করেছেন। যেমন, অন্যত্র আল্লাহ তাআলা নিজের শোকরের সঙ্গে বাবা-মায়ের শোকরকে একত্রিত করে অপরিহার্য করেছেন। বলা হয়েছে- ‘আমার শোকর কর এবং পিতা-মাতারও’ (সুরা লুকমান: আয়াত ১৪)

এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলার ইবাদতের পর বাবা-মায়ের আনুগত্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার ন্যায় বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াও ওয়াজিব। হাদিসে পাকে এসেছে-

কোনো এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করল, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন, সময় হলে নামাজ পড়া। সে আবার প্রশ্ন করল, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার।’ (মুসলিম ৮৫)

তাছাড়া বিভিন্ন হাদিসে বাবা-মায়ের আনুগত্য ও সেবাযত্ন করার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বাবা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা। এখন তোমাদের ইচ্ছা, এর হেফাজত কর অথবা একে বিনষ্ট করে দাও।’ (তিরমিজি ১৯০১)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত।’ (তিরমিজি ১৮৯৯)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ব্যক্তির নাক ধুলিমলিন হোক, তারপর ধুলিমলিন হোক, তারপর ধুলিমলিন হোক, সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে কে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যে বাবা-মায়ের একজন বা উভয়কে তাদের বৃদ্ধাবস্থায় পেল তারপর জান্নাতে যেতে পারল না।’ (মুসলিম ২৫৫১)

হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করেন, কোন আমল মহান আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সময়মত নামাজ আদায় করা। তিনি বললেন, তারপর কোন কাজ? তিনি বললেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে৯ সদ্ব্যবহার করা। তিনি বললেন, তারপর? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (বুখারি ৫৯৭০)

তবে সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর কাজে কোন সৃষ্ট-জীবের আনুগত্য জায়েয নয়। সে হিসেবে কোন কোন বিষয়ে বাবা-মায়ের আনুগত্য ওয়াজিব তো নয়ই; বরং জায়েযও নয়। কিন্তু বাবা-মায়ের সেবাযত্ন ও সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের মুসলিম হওয়া জরুরী নয়।

হজরত আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার জননী মুশরিকা। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাকে আদর-আপ্যায়ন করা জায়েয হবে কি? তিনি বললেন ‘তোমার জননীকে আদর-আপ্যায়ন কর।’ (মুসলিম ১০০৩)

কাফের বাবা-মা সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিচ্ছি তার বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে ওরা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদেরকে মেনো না।’ (সুরা আল-আনকাবুত: আয়াত ৮)

আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেন, ‘তোমার বাবা-মা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে বসবাস করবে। সদভাবে।’ (সুরা লুকমান: আয়াত ১৫)

অর্থাৎ যার বাবা-মা কাফের এবং তাকেও কাফের হওয়ার আদেশ করে এ ব্যাপারে তাদের আদেশ পালন করা জায়েয নয়, কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতে হবে। বলাবাহুল্য, আয়াতে ‘মারুফ’ বলে তাদের সঙ্গে আদর-আপ্যায়নমূলক ব্যবহার বোঝানো হয়েছে।

ইসলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের এমনই গুরুত্ব দিয়েছে যে, যদি জেহাদ ফরজে আইন না হয়, ফরজে কেফায়ার স্তরে থাকে, তখন বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া সন্তানের জন্যে জেহাদে যোগদান করা জায়েয নেই।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘একলোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে জেহাদের যাওয়ার অনুমতি চাইল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তোমার বাবা-মা কি জীবিত? সে বলল, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাহলে তুমি তাদের খেদমতে জেহাদ করো।’ (মুসলিম ২৫৪৯)

অনুরূপভাবে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করারও নির্দেশ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো লোকের জন্য সবচেয়ে উত্তম নেককাজ হলো, বাবার মৃত্যুর পরে তার বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।’ (মুসলিম ২৫৫২)

বাবা-মায়ের সেবাযত্ন ও আনুগত্য বাবা-মা হওয়ার দিক দিয়ে কোনো সময় ও বয়সের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। সর্বাবস্থায় এবং সব বয়সেই বাবা-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা ওয়াজিব। কিন্তু বার্ধক্যে উপনীত হয়ে বাবা-মা সন্তানের সেবাযত্নের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং তাদের জীবন সন্তানদের দয়া ও কৃপার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন যদি সন্তানের পক্ষ থেকে সামান্যও বিমুখতা প্ৰকাশ পায়, তবে তাদের অন্তরে তা ক্ষত হয়ে দেখা দেয়। অপরদিকে বার্ধক্যের উপসৰ্গসমূহ স্বভাবগতভাবে মানুষকে খিটখিটে করে দেয়। তদুপরি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে যখন বুদ্ধি-বিবেচনাও অকেজো হয়ে পড়ে, তখন বাবা-মায়ের বাসনা এবং দাবীদাওয়াও এমনি ধরনের হয়ে যায়, যা পূর্ণ করা সন্তানের পক্ষে কঠিন হয়। আল্লাহ তাআলা এসব অবস্থায় বাবা-মায়ের মনোতুষ্টি ও সুখ-শান্তি বিধানের আদেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে তার শৈশবকাল স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আজ পিতা-মাতা তোমার যতটুকু মুখাপেক্ষী, এক সময় তুমিও তদপেক্ষা বেশী তাদের মুখাপেক্ষী ছিল। তখন তাঁরা যেমন নিজেদের আরাম-আয়েশ ও কামনাবাসনা তোমার জন্যে কোরবান করেছিলেন এবং তোমার অবুঝ কথাবার্তাকে স্নেহমমতার আবরণ দ্বারা ঢেকে নিয়েছিলেন, তেমনি মুখাপেক্ষিতার এই দুঃসময়ে বিবেক ও সৌজন্যবোধের তাগিদ এই যে, তাদের পূর্ব ঋণ শোধ করা কর্তব্য।

আত্মীয়-স্বজন গরিব-দুঃখী ও মুসাফিরকে দান করার নির্দেশের পাশাপাশি মানুষকে অপচয় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ সুরায়। কেননা অপচয়কারীদের শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।' ঃ(সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ২৬-২৭)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে যেমন জীবিকা দান করেন আবার তাদের জীবিকা সংকুচিতও করে দেন তিনি। অভাবের সন্তান হত্যা করার মারাত্মক পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ সুরায়। ব্যভিচার ও হত্যার মতো জঘন্য পাপ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন-

‌- 'নিশ্চয় তোমার পালকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুচিতও করে দেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত,-সব কিছু দেখছেন। দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ। আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব, সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩০-৩৩)

দ্রব্যসামগ্রী মাফে বা ওজনে কম দিলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর দুর্যোগ ও বালা-মুসিবত চাপিয়ে দেন বলেছেন বিশ্বনবি। কুরআনুল কারিমের এ সুরায় আল্লাহ তাআলা মানুষকে সঠিক উপায়ে মাফ দেয়ার কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন-

'মেপে দেয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক দাঁড়িপালায় ওজন করবে। এটা উত্তম; এর পরিণাম শুভ। (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৩৫)

আল্লাহ তাআলা মানুষকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তোমদের হাড়-অস্থি যদি মাটির সঙ্গে মিশেও যায়, আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের জীবিত করবেন। তিনি তাতে সক্ষম। যে বিষয়ে অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন তুলেছিল। আল্লাহ তাআলা সে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-

'তারা বলে, যখন আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখনও কি নতুন করে সৃষ্টি হয়ে উঠবো? (হে নবি আপনি) বলুন, তোমরা পাথর হয়ে যাও কিংবা লোহা। অথবা এমন কোন বস্তু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন। তথাপি তারা বলবেঃ,আমাদের পুনরায় কে সৃষ্টি করবে? (হে রাসুলঃ! আপনি) বলুন, যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, এটা কবে হবে? বলুন, হবে, সম্ভবত খুব শিগগিরই।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৪৯-৫১)

এ সুরায়ও হজরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি ও তাকে সেজদার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। যা করতে শয়তান অস্বীকার করেছিল। এ সুরায় মানুষের অকৃতজ্ঞতার বিষয়টি ওঠে এসেছে। যখন বিপদ থেকে উদ্ধার করার পর তারা সে বিষয় অস্বীকার করে। আল্লাহ বলেন-

وَ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فِی الۡبَحۡرِ ضَلَّ مَنۡ تَدۡعُوۡنَ اِلَّاۤ اِیَّاهُ ۚ فَلَمَّا نَجّٰىکُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اَعۡرَضۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ الۡاِنۡسَانُ کَفُوۡرًا

'যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে, তখন শুধু আল্লাহ ব্যতিত যাদেরকে তোমরা আহবান করে থাক তাদেরকে তোমরা ভুলে যাও। অতপর তিনি (আল্লাহ) যখন তোমাদের স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন, তখন তোমরা (আবার) মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৬৭)

মানুষকে নামাজের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। যাতে মানুষ যথা সময়ে নামাজ আদায় করতে পারে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

'সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন আর ফজরের কুরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কুরআন পাঠ মুখোমুখি হয়। রাত্রির কিছু অংশ কুরআন পাঠসহ (তাহাজ্জুদে) জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়ত বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মর্যাদাসম্পদন্ন উচ্চ স্থানে পৌঁছাবেন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৭৮-৭৯)

এ সুরায় গুরুত্বপূর্ণ আবেদন ও প্রার্থনা ওঠে এসেছে। যে প্রার্থনায় রয়েছে মানুষের সত্যবাদী হওয়ার আবেদন। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা লাভের আবেদন। আর তাহলো-

رَّبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَانًا نَّصِيرًا

উচ্চারণ : 'রাব্বি আদখিলনি মুদখালা সিদকিও ওয়া আখরিঝনি মুখরাঝা সিদকিও ওয়াঝআললি মিল্লাদুংকা সুলতানান নাসিরা।'

অর্থ : 'হে পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন সত্যরূপে এবং আমাকে বের করুন সত্যরূপে এবং দান করুন আমাকে নিজের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৮০)

আল্লাহ তাআলা এ কুরআনে রোগের চিকিৎসা ও নেয়ামত দান করেছেন। অথচ বান্দা আল্লাহকে ছাড়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

'আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায় আমি মানুষকে নেয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দুরে সরে যায়; যখন তাকে কোনো অনিষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৮২-৮৩)

সুরাটির শেষ আয়াতে আল্লাহ নিজের পরিচয় ও অংশীদারিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-

وَ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ لَمۡ یَتَّخِذۡ وَلَدًا وَّ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ شَرِیۡکٌ فِی الۡمُلۡکِ وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ وَلِیٌّ مِّنَ الذُّلِّ وَ کَبِّرۡهُ تَکۡبِیۡرًا

'(হে রাসুল! আপনি) বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর; যিনি না কোনো সন্তান রাখেন, না তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো শরিক আছে এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোনো সাহয্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং আপনি স-সম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম বর্ণনা করতে থাকুন।' (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ১১১)

সুরা কাহাফ (১-৭৪)

আসহাবে কাহাফের ঘটনা সমৃদ্ধ সুরা কাহাফ মক্কায় নাজিল হয়েছে। সুরাটিতে ১১০ আয়াত এবং ১২টি রুকু রয়েছে। সুরাটি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের সত্যতা প্রমাণের অনেক বড় দলিল হিসেবে সমাদৃত। এ সুরার ৯নং আয়াতের কাহাফ শব্দটি এসেছে।

এ সুরাটিতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করা যুবকরা আল্লাহর কাছে এভাবে সাহায্য কামনা করেছে-

رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا

উচ্চারণ : 'রাব্বানা আতিনা মিল্লাদুংকা রাহমাতাও ওয়া হাইয়িই লানা মিন আমরিনা রাশাদা'

অর্থ : 'হে আমাদের পালনকর্তা! নিজের কাছ থেকে আমাদের রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ১০)

আল্লাহর স্মরণ ব্যতিত কোনো কাজ আগামী কাল বা ভবিষ্যতে করার কথা বলা ঠিক নয়। এসব ক্ষেত্রে কোনো কিছু ভুলে গেলে এ আয়াত তেলাওয়াত করা যেতে পারে। তবে আল্লাহ সঠিক পথ দান করবেন। এ বিষয়ে কুরআনে এসেছে-

'আপনি কোনো কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামীকাল করব।`আল্লাহ ইচ্ছা করলে' বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন (পড়ুন)-

وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَى أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَذَا رَشَدًا

'আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুন, আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ২৪)

এ সুরায় হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও খিজির আলাইহিস সালামের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। অতপর কিছু ঘটনা বা কাজের প্রসঙ্গে মুসা আলাইহিস সালাম নিজের ভুল কাজে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুমিন মুসলমানও নিজেদের ভুল ও গাফলতির অন্যায় থেকে মুক্ত থাকতে কুরআনের এ ভাষা ব্যবহার করে আল্লাহর কাছে এ আবেদন করতে পারেন নিঃসন্দেহে-

لَا تُؤَاخِذْنِي بِمَا نَسِيتُ وَلَا تُرْهِقْنِي مِنْ أَمْرِي عُسْرًا

উচ্চারণ : লা তুআখিজনি বিমা নাসিতু ওয়া লা তুরহাক্বনি মিন আমরি উসরা'

অর্থ : 'আমাকে আমার ভুলের জন্যে অপরাধী করবেন না এবং আমার কাজে আমার উপর কঠোরতা আরোপ করবেন না।' (সুরা কাহফ : আয়াত ৭৩)

উল্লেখ্য, মক্কার মুশরিকরা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আহলে কিতাবের অনুসারীরা তাঁর সামনে তিনটি প্রশ্ন করেছিল। সে প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ তাআলা সুরা কাহাফ নাজিল করেছেন।

প্রশ্ন তিনটি হলো-

> আসহাবে কাহাফ কারা ছিল?

> হজরত খিজিরের ঘটনা ও তাৎপর্য কি কি? হাদিসের বর্ণনা মতে দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল রূহ সম্পর্কে।

> জুলকারনাইনের ঘটনাটি কি?

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা কাহাফের মাধ্যমে বনি ইসরাইলদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। আর তাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ের সত্যতা প্রকাশিত হয়েছে। এভাবেই আল্লাহ তাআলা ইসলামকে বিজয়ী করেছেন।

আজকের তারাবিহর শেষ আয়াতে মুসা আলাইহিস সালামের সামনে একজন নিষ্পাপ ছোট্ট বালককে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটে। আর তা ছিল এমন-

'অতপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন একটি বালকের সাক্ষাত পেলেন, তখন তিনি তাকে হত্যা করলেন। মূসা বললেন, আপনি কি একটি নিস্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই? নিশ্চয়ই আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।' (সুরা কাহফ : আয়াত ৭৪)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরা দুটি বুঝে পড়ার এবং তাওহিদ রেসালাত ও পরকালের ওপর গভীর বিশ্বাস রেখে নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। কুরআনি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।