জান্নাতি সাহাবি-১: রাসুলের খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)

আদর্শিক একনিষ্ঠতা, চারিত্রিক মাধুর্যতা, নীতি-জ্ঞানে পরিপক্বতা, ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠতা, কর্তব্য-নিষ্ঠা, ত্যাগের মহিমা, জ্ঞানের গভীরতা আর নিঃস্বার্থ প্রজা পালনে পৃথিবীর ইতিহাসে যেসব রাষ্ট্রনায়ক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে যাঁর নামটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করতে হয় তিনি হলেন- খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম খলিফা, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত প্রথম সাহাবি, খলিফাতুর রাসুলখ্যাত হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু।
জন্ম
৫৭৩ সালের দিকে আরবের ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের দুই বছরেরও কিছু বেশি সময় পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাসুলের ইন্তেকালের পর একই ব্যবধানে। তিনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমান হায়াত পেয়েছিলেন। তাঁর বংশপরম্পরা ৬ষ্ঠ পুরুষে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধারায় মিলিত হয়।
পরিচয়
তাঁর নাম ছিল আবদুল্লাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম ছিল আবু বকর, উপাধি আতিক, সিদ্দিক ও খলিফাতুর রাসুল। তাঁর পিতার নাম ছিল উসমান আর ডাকনাম ছিল আবু কুহাফা। মাতার নাম ছিল সালমা আর কুনিয়াত ছিল উম্মুল খায়ের। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, মেদহীন হালকা দেহসৌষ্ঠব ও প্রশস্ত ললাটবিশিষ্ট হজরত আবু বকর ছিলেন বেশ সুদর্শন, সচ্ছল, ব্যবসায়ী ও সামাজিক নেতৃত্বে মর্যাদাবান।
শৈশব- কৈশোর
আরবের ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ দলপতির একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শৈশব ও কৈশোর মর্যাদাপূর্ণভাবে কেটেছে। বিলাসিতার মধ্যে প্রতিপালিত হলেও হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনে জাহেলি যুগের নীতিহীনতা বা বর্বরতার কোনো স্পর্শ লাগেনি। তিনি কোনো দিন শিরক করেননি এবং মূর্তির জন্য অর্চনা দেননি। তিনি ছিলেন হানিফ ঘরানার প্রথম সারির ব্যক্তি।
তিনি ছিলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাল্যসঙ্গী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধিকাংশ বাণিজ্য সফরে তিনি ছিলেন সফরসঙ্গী। কেননা মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই তাঁকে পারিবারিক বাণিজ্যের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। সিরিয়া সীমান্তে যে সফরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক বুহাইরা বা নাসতুরা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবি হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সে সফরেও হজরত আব বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রাসুলের বাণিজ্যিক কাফেলার সফরসঙ্গী।
তাঁর আচরণ
মধুময় আচরণ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সচ্ছলতা, ব্যবসায়িক দক্ষতা, পরোপকারিতা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, জ্ঞান, মেধা ও পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি ছিলেন মক্কাবাসী সবার কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। অনেকে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী ছিল। বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি ছিলেন বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী। তাঁর কাব্য প্রতিভাও ছিল চমৎকার।
চারিত্রিক পবিত্রতা
জাহেলি যুগেও তিনি কোনো দিন শরাব পান করেননি। জাহেলি যুগে মক্কাবাসীর রক্তপণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। তাঁর বাড়িতেই প্রতিদিন পবিত্র নগরী মক্কার বিখ্যাত শরিফ লোকদের মজলিস বসত।
ইসলাম গ্রহণ
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাত প্রাপ্তির দ্বিতীয় দিনেই পবিত্র ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনিই ছিলেন বয়স্ক ও পুরুষদের মধ্যে এবং কুরাইশ বংশের ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি। তিনি এ দিক দিয়েও সৌভাগ্যবান যে তাঁর মা-বাবা দুজনই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন মুসলমান। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে এক হাদিসে বলেছেন, আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া সবার মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করেছি।
নবিজির সঙ্গে সম্পর্ক
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রেসালাতপ্রাপ্তির পর সে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে গমন করা। এমনকি কোনো বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গেই করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনি দাওয়াত নিয়ে কোথাও গেলে তাঁকেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
হিজরতের সঙ্গী
হিজরতের কঠিন সফরে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুই ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী। হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে চরম মর্মবেদনা পেয়েছিলেন, হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর কন্যা হজরত আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বিবাহ দেন এবং মোহরানার অর্থ নিজেই পরিশোধ করেন।
অভিযান ও হজ কাফেলার সঙ্গী
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতগুলো অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন, হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন প্রত্যেক অভিযানেই তাঁর সঙ্গী। নবম হিজরিতে প্রেরিত প্রথম ইসলামি হজ কাফেলায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আমিরুল হজ নিয়োগ করেন।
ইমামতির দায়িত্ব অর্পন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত তখন তাঁর নির্দেশে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে নববিতে নামাজে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। এসব থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাঁর কত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আর এ কারণেই তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
সিদ্দিক উপাধি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাঁর এত নিখাদ বিশ্বাস ছিল যে, যখন মেরাজের ঘটনাকে কাফেররা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছিল, যার ফলে কপট শ্রেণির কিছু মুসলমান মুরতাদ হয়ে গেল এবং অনেক সাধারণ মুসলমানের মন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে দুলছিল; তখন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, আল্লাহর কসম! তিনি আল্লাহর রাসুল। তিনি সত্যই বলছেন, তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না। কাফিরদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর দ্বিধাহীন ও দৃঢ় ঘোষণার কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করেন।
ইসলামের জন্য অবদান
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর অসামান্য অবদান রয়েছে। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি প্রত্যেকটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসান এমন যে আমি পরিশোধে অক্ষম। তাঁর প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তাঁর অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি। তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাবেই কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান, সাদ, তালহাসহ আরও অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার দিরহাম। যার সম্পূর্ণটাই তিনি ইসলামের জন্য ব্যয় করেছেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন, তিনি তাদের নিজ অর্থের বিনিময়ে কিনে মুক্ত করে দেন।
হজরত বেলাল, খাব্বাব, আম্মার ও তাঁর মা সুমাইয়া, সুহাইব, আবু ফুকাইহসহ অনেকেই তাঁর অর্থের বিনিময়ে স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেয়েছিলেন। তাঁর শানেই নাজিল হয়েছিল সুরা আল-লাইলের ৫, ৬ ও ৭ আয়াত- 'যে ব্যক্তি দান করল ও তাকাওয়া অবলম্বন করল আর যা কিছু উত্তম তা সত্য বলে গ্রহণ করল, তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ (জান্নাত)।’
তবুক অভিযানে তিনি ছিলেন মুসলিম সেনাদলের পতাকাবাহী। এ অভিযানের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাহাবাদেরকে সাধ্যমত দানের আহ্বান জানালেন, হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন তাঁর সমুদয় অর্থ রাসুলের খেদমতে পেশ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, পরিবারের জন্য বাড়িতে কী রেখে এসেছ? তিনি তখন জবাব দিলেন তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই যথেষ্ট।
নবিজির ইন্তেকালে আবু বকরের ঘোষণা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম একেবারেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। রাসুলের মৃত্যু হতে পারে বিষয়টি তাঁদের ভাবনাতেই যেন ছিল না। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কোষমুক্ত তরবারি হাতে ঘোষণা করলেন, যে বলবে- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেছেন; তাঁকে হত্যা করবো। এমন অবস্থায় হজরত আবু বকর (রা.) এগিয়ে গেলেন, স্থির চিত্তে তিনি ঘোষণা করলেন, যারা মুহাম্মদের ইবাদত করতো তারা জেনে রাখো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করো তারা জেনে রাখো, আল্লাহ চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। এরপর তিনি পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করলেন-
وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِهِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡهِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰهُ الشّٰکِرِیۡنَ
‘আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসুল। তার আগে নিশ্চয়ই অনেক রাসুল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।’
হজরত আবু বকরের বক্তব্য
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য শুনে সাহাবায়ে কেরাম সম্বিত ফিরে পেলেন। অবস্থা স্বাভাবিক হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাফনকাজ তখনো সম্পন্ন হয়নি এমন সময় মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে চরম বিরোধের সৃষ্টি হলো। আনসাররা দাবি করলেন যেহেতু আমরা রাসুলকে আশ্রয় দিয়েছি, জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে দুর্বল ইসলাম শক্তিশালী করেছি, তাই রাসুলের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার হক আমাদেরই। অপর দিকে মহাজিররা বললেন, ইসলামের বীজ আমরা বপন করেছি, আমরাই তাঁকে যত্ন ও লালন করেছি। সুতরাং খেলাফতের হকদার আমরাই। অবস্থা যখন দুই দলের বাদানুবাদে বিস্ফোরণোন্মুখ তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারকের কাছ থেকে বেরিয়ে এলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
খেলাফত সমস্যার সমাধান ও দায়িত্ব গ্রহণ
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। আনসাররা তাঁর যুক্তি মেনে নিলেন। উপস্থিত সবার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খলিফা নিযুক্ত হলেন। এভাবে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তায় এক মারাত্মক ও জটিল সমস্যার সমাধান হয়। খোলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই খলিফাতুর রাসুল বলা হয়।
খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর ভাষণ
খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক সংক্ষিপ্ত ও নীতিনির্ধারণী বক্তব্য প্রদান করেন, যা চিরকাল বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠের পর বলেন-
আল্লাহর শপথ! আমি চেয়েছিলাম আপনাদের মধ্য থেকে কেউ এ গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হলো। যদি আপনারা চান আমার আচরণ রাসুলের আচরণের মতো হোক তাহলে সে ক্ষেত্রে আমাকে অক্ষম মনে করবেন। কারণ তিনি ছিলেন নবি, সব ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত।
আর আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি যদি সঠিক কাজ করি তাহলে আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। আর যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, তাহলে আমাকে সতর্ক করে দেবেন।
জাকাত অস্বীকারকারীদের প্রতি অভিযান
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের সুযোগে আবাস ও জুবইয়ান গোত্রদ্বয় জাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। বিষয়টি নিয়ে খলিফার দরবারে পরামর্শ সভা বসে। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু খলিফাতুর রাসুল হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় উটের যে বাচ্চাটি জাকাত হিসেবে দেওয়া হতো, এখন যদি কেউ সেটিও দিতে অস্বীকার করে তাহলেও আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।
মিথ্যা নবিদের প্রতিহত
আবার কিছু লোক রমরমা ব্যবসার মানসে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবি করে বসে। কিছু বেদুঈন সম্প্রদায় ইসলামি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টা করে। হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে কঠোর হাতে তাদের দমন করে ইসলামি খেলাফতকে সংকটমুক্ত করেন।
ইসলামের ত্রাণকর্তা আবু বকর
বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসলামি খেলাফতকে রক্ষার জন্য ঐতিহাসিকরা তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলামের সবচেয়ে বড় যে খেদমতটি করেছেন তা হলো, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা পবিত্র কোরআনের পাণ্ডুলিপিগুলো একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ কপি তৈরি করেন। এটি মাসহাফে সিদ্দিকী নামে পরিজিদ। আর এ মাসহাফে সিদ্দিকীই পরবর্তী সময়ে পবিত্র কোরআন গ্রন্থাকারে সংকলনে মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের কারণে তিনি খুব বেশি হাদিস বর্ণনা করেননি।
ইন্তেকাল ও দাফন
মহৎ জীবনের ধারক, খলিফাতুর রাসুল হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ১৫ দিন রোগভোগের পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের ২৩ তারিখ মোতাবেক ১৩ হিজরি ২২ জমাদিউস সানি ইন্তেকাল করেন। হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন। এরপর হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হুজরায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে পূর্ব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর জীবনের যেসব গুণগুলো তাঁকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সর্বাধিক প্রিয় করে তুলেছিল সেসব গুণে রঙিন হোক মুসলিম উম্মাহর জীবন। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস