জুমার প্রথম খুতবা: হজের কিছু পরিভাষা

আজ শুক্রবার। বরকতময় হজের প্রস্তুতির মাস জিলকদের দ্বিতীয় জুমা আজ। ০৯ জুন ২০২৩ ইংরেজি, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বাংলা, ১৯ জিলকদ ১৪৪৪ হিজরি। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- হজের কিছু পরিভাষা।
হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন যে ব্যক্তির মালিকানায় নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র এবং নিজের ও পরিবারের ভরণ-পোষণের খরচের অতিরিক্ত এমন পরিমাণ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-রূপা বা জমিজমা রয়েছে, যা দ্বারা সে হজে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজকালীন সময়ে সাংসারিক খরচ মেটাতে সক্ষম। তার ওপর হজ আদায় করা ফরজ। আর এ হজ জীবনে একবারই ফরজ। ফরজ হজ আদায়ের পর বার বার হজ করলে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে।
সামথ্যবান মানুষের ওপর হজ করা ফরজ। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন-
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ
‘আর সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ৯৭)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
এ আয়াতে কারিমায় মহান আল্লাহ তাআলা সামথ্যবান মানুষকে তাঁর ইবাদত হজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে। সম্পূর্ণ রাহা-খরচ পূরণ হওয়ার মত যথেষ্ট পাথেয় যার কাছে আছে। অনুরূপ রাস্তার ও জান-মালের নিরাপত্তা এবং শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদিও সামর্থ্যের অন্তর্ভুক্ত। নারীর জন্য মাহরাম (স্বামী অথবা যার সঙ্গে তার বিবাহ চিরতরে হারাম এমন কোন লোক) থাকাও জরুরি। (ফাতহুল কাদির) এই আয়াত প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ ফরজ হওয়ার দলিল। হাদিস দ্বারা এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হজ জীবনে একবারই ফরজ। (ইবনে কাসির)
হজের সফরে ব্যবহৃত কিছু পরিভাষা
১. ইহরাম বাঁধা
হজ বা ওমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধা। নির্ধারিত মিকাত থেকে (সম্ভব হলে) গোসল করে অথবা অজু করে পুরুষরা সেলাইবিহীন ২টি কাপড় পরবে। আর নারীরা পর্দাসহ শালীন পোশাক পরবে। এরপর ২ রাকাত নামাজ পড়ে ওমরার নিয়ত করে নেওয়া।
২. ইহরামের পর নিয়ত করা
যারা ওমরা করবেন
اَللَّهُمَّ اِنِّي اُرِيْدُ العُمْرَةَ فَيَسِّرْهُ لِيْ وَ تَقَبَّلْهُ مِنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরার ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
অথবা এভাবেও ওমরার নিয়ত করা যাবে
لَبَّيِكْ عُمْرَةً - اَللَّهُمَّ لَبَّيِكْ عُمْرَةً
উচ্চারণ : ‘লাব্বাইক ওমরাতান’ অথবা ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ওমরাতান’
যারা হজ করবেন
নির্ধারিত মিকাত থেকে (সম্ভব হলে) গোসল করে অথবা অজু করে পুরুষরা সেলাইবিহীন ২টি কাপড় পরবে। আর নারীরা পর্দাসহ শালীন পোশাক পরবে। এরপর ২ রাকাত নামাজ পড়ে হজের নিয়ত করে নেবে-
اَللَّهُمَّ اِنِّي اُرِيْدُ الْحَخَّ فَيَسِّرْهُ لِيْ وَ تَقَبَّلْهُ مِنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল হাজ্জা ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি হজের ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
অথবা এভাবেও হজের নিয়ত করা যাবে-
لَبَّيِكْ حَجًّ - اَللَّهُمَّ لَبَّيِكْ حَجًّ
উচ্চারণ : ‘লাব্বাইক হাজ্জান’ অথবা ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক হাজ্জান’
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই নিয়ত করেছেন। যারা হজ বা ওমরার উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে বের হবেন, তাঁরা গাড়ি বা বিমান বা অন্য যে কোনো বাহনেই থাকেন; ইহরামের পর বাহনে আরোহনের সময়ই উল্লিখিত নিয়তের শব্দ সমূহ মুখে উচ্চারণ করা উত্তম।
৩. তালবিয়া
হজের সফরে সবচেয়ে বেশি তালবিয়া পড়তে হয়। তাহলো-
لَبَّيْكَ ا للّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ اِنَّ الْحَمدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ
তালবিয়ার উচ্চারণ
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্ক, লা শারিকা লাক।
তালবিয়ার অর্থ
আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই।
৩. ইছতিলাম
হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া অথবা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বা হাত দিয়ে ইশারা করে তালুতে চুমু খাওয়া। রুকনে ইয়ামানিকে হাত দিয়ে স্পর্শ করাকেও ইছতিলাম বলা হয়।
৪. ইযতিবা
পুরুষের জন্য ইহরামের চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে বের করে বাম কাঁধের উপর রাখাকে ইযতিবা বলে। যে তওয়াফের পর সায়ি আছে সে তওয়াফ অবস্থায় এটা করণীয়।
৫. রমল
যে তওয়াফের পর সায়ি আছে সে তওয়াফের প্রথম তিন চক্কর কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে ছোট ছোট পদে একটু দ্রুত ও বীরদর্পে হাঁটা।
৬. সায়ি
তওয়াফ সম্পন্ন করার পর সাফা ও মারওয়ার মাঝে বিশেষ নিয়মে সাতবার চক্কর দেওয়া।
৭. মসজিদে হারাম
বাইতুল্লাহ শরিফকে চতুর্দিক থেকে যে বিশাল মসজিদ ঘিরে রেখেছে এটাই মসজিদে হারাম বা হারাম শরিফ।
৮. মুলতাযেম
হাজরে আসওয়াদ এবং বাইতুল্লাহ শরিফের দরজার মধ্যবর্তী অংশের দেওয়াল।
৯. রুকনে ইয়ামেনি
বাইতুল্লাহ শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণকে রুকনে ইয়ামেনি বলা হয়। হাজির এ স্থানটিকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করতে সামর্থ্য না হলে হাতে ইশারা করে। এ স্থান থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত স্থানে একটি বিশেষ দোয়া পড়ে থাকেন।
১০. হেরেম
মসজিদে হারামের চতুর্দিকে কিছু দূর পর্যন্ত নির্দিষ্ট এলাকাকে হেরেম বলা হয়। চারদিকে এর সীমানা চিহ্নিত রয়েছে। এখানে যুদ্ধ করা, পশুপাখি শিকার করা, গাছ কাটা নিষেধ। এখানে কাফেরদের প্রবেশও নিষেধ। হেরেমের বাইরের অংশকে ‘হিল’ বলে।
১১. মিকাত
মক্কাগামী বা হাজ্বীদের জন্য যে স্থান ইহরাম ব্যতীত অতিক্রম করা জায়েয নয় সেই স্থানকে ‘মীকাত’ বলা হয়। যেমন বাংলাদেশ থেকে বিমানের যাত্রীদের জন্য মীকাত ‘কারনুল মানাযিল’ ও ‘যাতু র্ইক’-এর মধ্যবর্তী স্থান।
১২. হিল
হেরেমের সীমানার বাইরে মীকাতের আগ পর্যন্ত স্থানকে হিল বলে।
১৩. দম
ওমরাহ ও হজের আমলে বিশেষ ত্র“টি হলে কিংবা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে ফেললে হেরেমের এলাকায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি ছাগল-দুম্বা বা উট-গরুর সাত ভাগের এক ভাগ কুরবানী করাকে দম বলে। আর কোনো কোনো ভুলের কারণে গোটা গরু বা উট জবাই করতে হয়, একে ‘বাদানা’ বলে।
১৪. তওয়াফ
হাজরে আসওয়াদের কোণ থেকে শুরু করে পুরো কাবা ঘর বিশেষ নিয়মে সাতবার চক্কর দেওয়া।
১৫. তওয়াফে যিয়ারত
এটি হজের ফরয তাওয়াফ। ১০ জিলহজ সুবহে সাদিক থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের ভিতর এ তাওয়াফ করা হয়।
১৬. উকুফ
উকুফ অর্থ অবস্থান করা। নির্দিষ্ট সময়ে আরাফা ও মুযদালিফায় অবস্থান করাকে ‘উকুফ’ বলা হয়।
১৭. জামরাহ
হাজিগণ মিনার যে তিনটি স্থানে কংকর নিক্ষেপ করেন তার প্রত্যেকটিকে ‘জামরাহ’ বলে, এর বহুবচন ‘জামারাত’।
১৮. তওয়াফে বিদা
তাওয়াফে যিয়ারতের পর মক্কা থেকে বিদায়ের আগে যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে বিদা বলে। একে তাওয়াফে সদরও বলা হয়।
১৯. হাতিম
বাইতুল্লাহ শরীফ সংলগ্ন উত্তর দিকে মানুষ সমান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা অংশ। এটি মূলত কাবা ঘরেরই অংশ।
২০. মাকামে ইবরাহিম
কাবার পূর্ব দিকে অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইরাকির মাঝ বরাবর মাতাফে কাঁচে ঘেরা একটি পাথর। যার উপর হযরত ইবরাহীম আ.-এর পদচিহ্ন রয়েছে।
এসবই হজের পরিভাষায়। আল্লাহ তাআলা হজ পালনকারীদের জন্য প্রতিটি স্থানে যথাযথ নিয়মে হজের কাজগুলো সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস