সকালের মক্তব শিশুদের নৈতিক শিক্ষার পাঠশালা
আবু তালহা তোফায়েল
সকালের মক্তব শিক্ষা হচ্ছে শিশুদের ধর্মীয় মূল্যবোধের পাঠশালা, কোরআন শিক্ষার প্রাথমিক স্তর। সকালের মক্তবে মুসলমানরা তাদের মৌলিক শিক্ষা পায়। যে শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর ওপর ফরজ। সুনানে ইবনে মাজায় সংকলিত একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ।’ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় হাদিস বিশারদরা উল্লেখ করেছেন যতটুকু জ্ঞান অর্জন না করলে শরিয়ত নির্দেশিত হুকুম আহকাম মেনে চলা, হালাল হারাম পার্থক্য করা সম্ভব নয়, ততটুকু জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।
সকালের মক্তবের সূচনা
সকালের মক্তবব্যবস্থা বহু যুগ ধরে মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। একজন মুসলমান হিসেবে যতটুকু জ্ঞান অর্জন জরুরি তার সিংহভাগ মক্তব থেকেই অর্জন করা সম্ভব। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে অজু করতে জানে না বা ফরজ গোসল করতে জানে না, সে নামাজ পড়বে কীভাবে? অন্তত নামাজ পড়ার জন্য কিছু সুরা শুদ্ধভাবে জানা প্রয়োজন এবং একজন মুসলমান হিসেবে সেগুলো শিখে রাখা জরুরি। এমন চিন্তা থেকেই এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে মসজিদে মসজিদে চালু হয় মক্তব শিক্ষা, যেন প্রতিটি শিশু ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জন করতে পারে। বিশেষ করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যে এটা বিস্তার লাভ করে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এর যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। মক্তবে সহিহ-শুদ্ধভাবে সুরা-কেরাত পড়ার যোগ্যতা অর্জন, বিশুদ্ধভাবে নামাজ আদায়ের মাসয়ালা শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে অজু, গোসল, তায়াম্মুম, দোয়া-দরুদ, কালেমা, নামাজ, রোজা, মৃত ব্যক্তির গোসল, কাফনের কাপড় পরানো, দাফন করার নিয়মসহ বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। এ মক্তব ব্যবস্থা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে।
সকালের মক্তব শিশুদের নৈতিক শিক্ষার পাঠশালা
মক্তবে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও বড়দের সালাম এবং সম্মান দেওয়া, সুন্দর ও মার্জিত ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। শৈশবেই এ আদবগুলো সন্তানদের শিক্ষা দেওয়া না গেলে সে সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবাল মক্তব সম্পর্কে যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো, যদি এ মক্তব-মাদরাসা না থাকতো, তাহলে মুসলমানের সন্তানরা নৈতিকতা হারিয়ে ইহুদি খ্রিষ্টানের অন্ধ অনুসরণে নিজেদের পরিচয়টুকুও হারিয়ে ফেলতো। মুছে যেতো মুসলমানের আদর্শ ও স্বকীয়তা।
সকালের মক্তবের গুরুত্ব
সকালের মক্তবে যারা পড়েছে, তাদের সহজে কেউ ইমান হারা করতে পারে না। শিশুর মন নরম কাদামাটির মতো। যার শিশু হৃদয়ে ইমান গেঁথে যায়, পরে সে লোভ-লালসা কিংবা দুনিয়াবি কোনো কারণে ফরজ বিধানগুলো সাময়িক ছেড়ে দিলেও ইমান ছাড়বে না।
দুঃখজনক হলো, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সকালের মক্তবের গুরুত্ব ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। সিলেটের একজন ইমাম যিনি দেড়যুগ থেকে ইমামতি ও মক্তবের দায়িত্বে আছেন, সেদিন জানালেন, ২০০৫ সালে যে মক্তবে ১০০ শিক্ষার্থী ছিল, বর্তমানে সেই মক্তবে পড়তে আসে মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী। তাও মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে। শিক্ষার্থীরা বিকেলে আসতে চায়। ভোরে পরীক্ষা-প্রাইভেট থাকে অথবা ঘুমিয়ে থাকে। এ অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সকালের মক্তবের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির উচিত এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক : তরুণ আলেম, সাংবাদিক ও সংগঠক।
ওএফএফ/এমএস