নবিজির (সা.) বিনয় ও ইনসাফ

ওমর ফারুক ফেরদৌস
ওমর ফারুক ফেরদৌস ওমর ফারুক ফেরদৌস , আলেম ও লেখক
প্রকাশিত: ০২:০৭ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
বদরপ্রান্তরে অবস্থিত এই স্মৃতিস্তম্ভে বদরের শহিদদের নাম লেখা রয়েছে

আমরা সবাই মাঝে মধ্যে অন্যের ওপর অন্যায়-জুলুম করে ফেলি। দুনিয়ায় চেষ্টা করলে খুব সহজেই আমরা এ সব অন্যায় বা জুলুমের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারি। তা না হলে কেয়ামতের দিন  আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়িয়ে এ সব জুলুমের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, 

وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

আর তোমরা সে দিনের ভয় কর, যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে যা উপার্জন করেছে, তা পুরোপুরি দেয়া হবে। আর তাদের যুলম করা হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮১)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে চাবুক দিয়ে মেরেছে, তার থেকেও কেয়ামতের দিন প্রতিশোধ নেওয়া হবে। (তাবরানি)

তাই ওই কঠিন দিনের আগেই নিজের ভুল ও অন্যায়ের প্রতিবিধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। কারো ওপর জুলুম করে থাকলে মজলুম ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়া, ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বা তাকে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করা উচিত। 

আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, একদিন রাসুল সা. সাহাবিদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি বলতে পার, নিঃস্ব বা দেউলিয়া কে? সাহাবিরা বললেন, যার টাকা কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই, আমরা তো তাকেই নিঃস্ব মনে করি। রাসুল সা. বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সেই প্রকৃত অভাবগ্রস্ত, যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভোগ করেছে, কাউকে পিটিয়েছে, কাউকে হত্যা করেছে। তার কথা ও কাজের কারণে যারা নির্যাতিত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার থেকে নেক আমল দেয়া হবে, তার নেক আমল শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপের একাংশ তার ওপর চাপানো হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম) 

আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসুল, শাসক ও নেতা হয়েও কারো প্রতি কোনো ভুল হয়েছে মনে হলে ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করতেন না। তিনি জেনেবুঝে কাউকে কষ্ট দিতেন না। এরপরও কেউ কোনো আচরণে কষ্ট পেয়েছে মনে হলে বিনা দ্বিধায় ক্ষমা চেয়ে নিতেন, এমন কি প্রতিশোধ নিতে চাইলে সেই সুযোগও দিতেন। 

এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল বদর যুদ্ধের ময়দানে। ইবনে হিশাম, ইবনে কাসির এবং নবিজির (সা.) অন্যান্য জীবনীকাররা বর্ণনা করেন, বদরের যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সৈন্যদের সারি সোজা করছিলেন। তার হাতে ছিল একটি তীর, যা দিয়ে তিনি সৈন্যদের সারি সোজা করছিলেন। হজরত সাওয়াদ ইবনে গাজিয়া (রা.) সারি থেকে সামান্য এগিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার পেটে হালকাভাবে তীর ঠেলে বললেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও, সাওয়াদ। 

সাওয়াদ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে আঘাত করেছেন,  অথচ আল্লাহ আপনাকে ন্যায়বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আমি আমার প্রতিশোধ চাই।

আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটুও ক্রুদ্ধ না হয়ে এবং কোনো দ্বিধা না করে তার পেট থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন, প্রতিশোধ নাও।

সুযোগ পেয়ে সাওয়াদ (রা.) প্রতিশোধ নেওয়ার বদলে নবিজির পবিত্র পেটে চুমু খেলেন। নবিজি (সা.) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেন এমন করলে! 

সওয়াদ (রা.) বললেন, আল্লাহর রাসুল! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। জানি না এরপর বেঁচে থাকব কি না। তাই আমি চেয়েছি মৃত্যুর আগে আপনার শরীরের সঙ্গে আমার শরীরের স্পর্শ হোক।

আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন, সোজা হয়ে দাঁড়াও, সাওয়াদ।

নবিজির (স.) জীবনের এ রকম আরও বহু ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। আল্লাহর রাসুল ও তৎকালীন মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান হয়েও তিনি অধীনস্তদের কাছে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে এমন কি প্রতিশোধের সুযোগ দিতেও দ্বিধা করতেন না। এ ঘটনায় আমরা নবিজির (সা.) বিনয় ও ইনসাফ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। একইসাথে আমরা বুঝতে পারি নবিজির (সা.) সঙ্গীরা তাকে কতটা পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন। 

ওএফএফ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।