পণ্য সরবরাহ সচল রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবে দেখছেন না খামারিরা

ফজলুল হক শাওন
ফজলুল হক শাওন ফজলুল হক শাওন , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৫:০৬ পিএম, ০৪ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য এবং এর সঙ্গে জড়িত পণ্য সরবরাহ সচল রাখার ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছেন খামারিরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত কিছুদিনে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে সে ক্ষতি তারা আবার পুষিয়ে উঠতে পারবেন, যদি এ বিষয়ে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়। তাদের পণ্য বাজারজাত করতে দিলেই তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণার সময় (এরমধ্যে ছুটি অবশ্য বেড়েছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত) সারাদেশে গণপরিবহনও বন্ধ করে দেয়া হয়। এসময় বন্ধ হয়ে যায় পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য এবং এর সঙ্গে জড়িত পণ্য সরবরাহও। ফলে এসব পণ্য বাজারজাত করতে পারছিলেন না খামারিরা। এতে কোটি কোটি টাকার লোকসানে পড়তে হয় শত শত খামারিকে

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সরকারঘোষিত ছুটির সময় পোল্ট্রি, ডিম, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য, দুগ্ধজাতপণ্য, অন্যান্য প্রাণী ও প্রাণীজাত পণ্য, মাছ, মাছের পোনা ও মৎস্য খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন সচল রাখার ব্যবস্থা নিতে সব জেলা প্রশাসক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর এ নির্দেশনা এখনো (আজ শনিবার, ৪ এপ্রিল) অনেকে জানেন না। সেজন্য সিরাজগঞ্জে আজও দুধের লিটার ১৫ থেকে ১৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্য ও সিদ্ধান্তের কথা জেনেছেন কিছু খামারি। তারা এ সিদ্ধান্তের কথা শুনে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা যা চাচ্ছি মন্ত্রী তা-ই বলেছেন।

এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের দুগ্ধ খামারি সমিতির পরিচালক আব্দুস সামাদ ফকির জাগো নিউজকে বলেন, আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত সরকারের কোনো নোটিশ বা সিদ্ধান্তের কথা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিনি। অন্য কোনো খামারিও জানেন না।

তিনি বলেন, আজ সকালেও দুধ লিটারপ্রতি ১৫-১৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিন দিন আগে মন্ত্রী মহোদয় নির্দেশনা দিয়েছেন, অথচ এখনো আমাদের খামারিরা দুধ বিক্রি করতে পারছেন না। রাস্তাঘাটে কোনো যানবাহন নেই। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা, তারাও যৎসামান্য দুধ কিনেই কর্তব্য শেষ করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুস সামাদ ফকির বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য এবং মানুষের পুষ্টির অভাব দূর জন্য মিল্কভিটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার যে উদ্দেশ্য ছিল সে উদ্দেশ্য আজ ব্যর্থ হতে চলেছে। দুধ বিক্রি করতে না পেরে দেশের লাখ লাখ খামারি কোটি কোটি লিটার দুধ নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন।

২ এপ্রিলের সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে সকল বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের খামারিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়া ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ মর্মে ভোক্তা পর্যায়ে প্রচারণা চালোনোর বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

কিন্তু মাঠ পর্যায়ের খামারিরা বলছেন, তারা মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কোনো নির্দেশনা বা দেখা পাননি।

এ বিষয়ে শেরপুর জেলার পোল্ট্রি খামারি মজিবুর রহমান জানান, তিনি মন্ত্রী বা সরকারের কোনো নির্দেশনা জানেন না। এ খামারি বলেন, আমরা ভালো নেই। মুরগির খাবারের দাম চড়া। ডিম আর ব্রয়লার মুরগির দাম কম। আজও ডিম ৫ টাকা করে বিক্রি করেছি। দূরে যেতে পারি না, যানবাহন না চলার কারণে। বাড়ির আশ-পাশের মুদির দোকানে ডিম সরবরাহ করছি।

তিনি বলেন, এখনো সরকার যদি আমাদের মুরগি ও ডিম বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়, স্বল্প আকারে হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে, আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

একই জেলার তুষার পোল্ট্রি খামারের মালিক সেলিনা পারভিন জাগো নিউজকে বলেন, আমার খামার এখন ফাঁকা। এবার প্রায় ১৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এর আগেও অ্যাডভান্স কোম্পানির ভ্যাকসিন দেয়ার কারণে সব মুরগি মারা গেছে। তখন লোকসান হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এখন আর ব্যবসা করার মতো কোনো পয়সা নেই। ঋণ যা আছে তা জমি বিক্রি করে শোধ করা লাগবে।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (সম্প্রসারণ, চ.দা) ডা. শেখ আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর থেকে আমরা খামারিদের সমস্যা দূর করার চেষ্টা করছি। মন্ত্রী মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। এ বিষয়গুলো দেখার জন্য একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। আশা করি লকডাউনের কারণে খামারিদের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা অচিরেই কেটে যাবে।

পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য এবং এর সঙ্গে জড়িত পণ্য সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে দায়িত্বরত উপ-সচিব (বাজেট) মো. মজিবুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আজ (শনিবার) কাজ শুরু করলাম। কন্ট্রোল রুম থেকে প্রতিটি জেলায় ফোন করে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হবে। খামারিদের পণ্য পরিবহন, বিক্রয় ও বিপণনসহ যাবতীয় কাজে সহযোগিতা করা হবে। যে কোনো খামারি কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে পারবেন এবং আমরা তার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করব।

উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া এবং পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে বিবেচিত। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকার ২৫ হাজারের বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। করোনার কারণে সব খামারিই ক্ষতির মুখে পড়েছেন

এফএইচএস/এইচএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।