করোনায় ঘরবন্দি ২০ হাজার কোটি টাকার নববর্ষের অর্থনীতি
গত বছরের এদিন ফুটপাত থেকে শুরু করে অলিগলির দোকানপাট, বিলাসবহুল বিপণিবিতানে বৈশাখী পোশাক কেনাকাটার উৎসব চলেছে। অনলাইনেও বৈশাখী পোশাকসহ বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি ছিল জমজমাট। বড় ব্র্যান্ড ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক উপহার পাঠিয়ে তাদের গ্রাহকদের বৈশাখী শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিস্তার রোধে দেশের বেশ কিছু স্থানে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে দেশবাসীকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠানে জনসমাগম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ঘরে বসে 'ডিজিটাল পদ্ধতিতে' পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য বলা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।
এমন অবস্থায় পহেলা বৈশাখকে ঘিরে প্রতিবছর যে রকম জমজমাট প্রস্তুতি থাকে, এবারে সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। যার প্রভাব পড়েছে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থনীতিতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
কয়েক বছর ধরে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বৈশাখে মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরাও পাচ্ছেন ভাতা। এভাবে সামাজিক, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ষবরণের ব্যাপ্তি বাড়ছে। ফলে বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার বড় হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে বেশ চাঙ্গা করেছে।
বৈশাখের উৎসবে সারা দেশে কতো টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এ উৎসবকে ঘিরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এর ওপর ভিত্তি করে শহর ও গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বিকাশ লাভ করেন। কিন্তু করোনার প্রভাবে ঘরবন্দি এবারের নববর্ষের অর্থনীতি।
বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এই অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন ‘এবারে পহেলা বৈশাখে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটার প্রভাব কিন্তু গ্রামের ওই পুতুল বানানোর কারিগর থেকে শুরু করে শহরের বিলাসবহুল বিপণিবিতানের ওপরও পড়েছে। কারণ তাদের বিক্রির একটা বড় উৎস হচ্ছে এই পহেলা বৈশাখ।’
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে উৎসব আয়োজন সেটা অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রতিবছর নববর্ষকে ঘিরে যে ধরনের পণ্যের কেনা-বেচা, উৎপাদন এবং উৎসবের আয়োজন হয় তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এগুলো মূলত দেশীয় পণ্য। একইসঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশের জন্য আয়োজন।’
‘তাই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে বিশাল যে উৎসব হয়, সেটার যে সার্বজনীন রূপ, তার কারণেই এর ব্যাপ্তি অনেক। এ অর্থনীতি কতো হাজার কোটি টাকার, তার চেয়ে গুরুত্বপর্ণ হচ্ছে বাংলা নববর্ষ ঘিরে আয়োজনটা গ্রামীণ অর্থনীতি, শহরের অর্থনীতি দুই জায়গার জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এমন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন তারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন এ ধরনের উৎসবের জন্য। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষের উৎসবের জন্য। এ উৎসবের পণ্য গ্রামে পুতুল, নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি অথবা তালপাতার পাখা, জামা-কাপড়। হয় খাওয়া-দাওয়া, হালখাতা। উৎসবের দিন নানা রকম গান-বাজনা, পুতুল নাচ, দেশী খেলাধুলার আয়োজন থাকে। সবকিছু মিলিয়ে এ উৎসবটা অনেক বড়।’
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বৈশাখী মেলা বাঙালির জীবনে অন্যতম একটা কমন ঘটনা। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সঙ্গত কারণে সরকার জনসমাগম করে এ উৎসব করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে এবার এ উৎসব হচ্ছে না। এর ফলে এ উৎসবকে ঘিরে যত ধরনের পণ্যের কেনা-বেচা হতে পারতো সেটা প্রায় হয়নি বললেই চলে।’
বাঁ থেকে ড. নাজনীন আহমেদ, হেলাল উদ্দিন, শাহীন আহম্মেদ
তিনি বলেন, ‘যেসব কারিগর এ উৎসবকে ঘিরে নানা কাপড়-চোপড় বানিয়ে রেখেছিলেন। এর সাথে যুক্ত যেসব শ্রমিক কাজ করেছেন, অনেক পণ্য উৎপাদিত হয়ে গিয়েছিল, তারা কিন্তু বিপাকে পড়েছেন। অনেকের মূলধন আটকে গেছে। অনেক জায়গায় কর্মচারীর বেতন দেয়া যাচ্ছে না। এসবের সাথে যুক্ত যেসব শ্রমিক গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তাদের যে পেমেন্ট সেটাও সমস্যার মধ্যে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা দেশীয় পেশাক-আশাক তৈরি করেন, এদের মধ্যে অনেক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন। সব মিলিয়ে বৈশাখের যে অর্থনীতি, সেটা এ বছর মন্দা বা বিপাকেই পড়লো। এটাকে ঘিরে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সেটা এবার হয়নি। ফলে বৈশাখের উৎসবের কারণে আমাদের অর্থনীতির জিডিপিতে যেটা যুক্ত হয় সেটা কিন্তু হলো না।’
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘প্রতিবছর যখন পহেলা বৈশাখ আসে তখন যৌক্তিক না হলেও আমরা ভাবতে থাকি ইলিশ মাছের দাম কত হবে? এ বছর বাজারে কিন্তু ইলিশ মাছের দাম একেবারে কম। এর মূল কারণ হচ্ছে যে পরিমাণ ইলিশ এসেছে সে পরিমাণ কেনার মতো মানুষের মন-মানসিকতাও নেই, সহজে ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না, বাজারেও যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘বৈশাখের উৎসবকে ঘিরে যত মানুষের সাময়িক বা খণ্ডকালীন কর্মসংস্থান হয় সেটা যেমন হলো না, আবার অনেকের মূলধন আটকে গেছে, যারা ইতোমধ্যে পণ্য উৎপাদন করে ফেলেছিলেন তারাও কিন্তু সমস্যায় রয়েছেন।’
‘তারপরও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে এ অর্থনৈতিক ক্ষতি আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে যে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ সময় বিপদে পড়েছেন, যাদের পণ্য আটকে আছে সেক্ষেত্রে যদি অনলাইন বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে বৈশাখের পরেও হয়তো এসব পণ্য বিক্রি করা যাবে। তবে বৈশাখের পোশাক-আশাকের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে, তাই সেগুলো সারাবছর বিক্রি সম্ভব নয়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দেশীয় পণ্যের ব্যবসায়ীদের পহেলা বৈশাখের উৎসবকে ঘিরেই বিনিয়োগ হয়ে থাকে। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে বর্ষবরণ উৎসব বন্ধসহ মার্কেট দোকান-পাট বন্ধ থাকায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ক্ষতি অপূরণীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কতো টাকার ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব করা কঠিন। কারণ এর প্রভাব আরও কতো দিন থাকে তা বলা যাচ্ছে না। তবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের সকল খাত মিলিয়ে অন্যান্য বছর ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। এ বছর আমাদের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। সেটা বেচা-কেনা করতে পারলে আমাদের ব্যবসা হতো ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। তবে আমরা সেটা বলবো না, যেহেতু বিনিয়োগ করেছি ১৫ হাজার কোটি টাকা। তাই আমাদের ক্ষতি ১৫ হাজার কোটি টাকাই বলবো।’
ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সভাপতি শাহীন আহম্মেদ বলেন, ‘করোনার কারণে মার্চের শুরুর দিকে বেচা-বিক্রি কমে যায়। এরপর প্রায় ৩০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার ফলে বৈশাখী বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে দেশীয় পোশাকশিল্প প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’
করোনাভাইরাসের থাবায় আতঙ্কিত বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা তাসলিমা আক্তারের জাগো নিউজকে বলেন, ‘এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই একটা প্ল্যান থাকে যে নতুন কাপড় কেনার। এবারও ভেবেছিলাম নতুন শাড়ি, মাটির গয়না পরে বের হবো। কিন্তু এর কিছুই আসলে হবে না। কারণ সবাই বাসায় বন্দি। উৎসবের আনন্দটাই এবার নেই।’
এমইউএইচ/এইচএ/এমকেএইচ