বিচারকরা চাইলে ভিডিও কনফারেন্সে মামলার শুনানি সম্ভব
করোনাভাইরাসের থাবায় থমকে গেছে দেশ। দিন দিন মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিস্তাররোধে সরকার দফায় দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করেছে। এই ছুটির আওতায় রয়েছে দেশের সব আদালত। এই পরিস্থিতিতে দেশের আদালতসমূহ সীমিত পরিসরে চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে তা স্থগিত করা হয়। পরে একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।
যদিও বাংলাদেশে অনলাইনে মামলা চালানোর ডাটাবেজ নেই। এ অবস্থায় ভার্চুয়াল আদালত চালু করা যাবে কি-না বা শুনানি সম্ভব কি-না, তা এ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ইকতান্দার বাপ্পী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম।
জাগো নিউজ : দীর্ঘদিন ধরে আদালত পাড়া বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে কিভাবে সময় পার করছেন?
ইকতান্দার বাপ্পী : করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২৫ মার্চ থেকেই কোয়ারেন্টাইনে আছি। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এই সাধারণ ছুটির সাথে তাল মিলিয়ে বিচারালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে আসামিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার বিধানটুকু রেখে সব কার্যক্রমই বন্ধ। যেহেতু আমরা আইনজীবী, কোর্ট আমাদের প্রাণ, ঘরে বসে থাকা একদমই আমাদের কাজ নয়। তবে এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে বাসায় থাকতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : বাসায় কিভাবে সময় পার করছেন?
ইকতান্দার বাপ্পী : বাসায় থাকতে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন ঘুমে বেশ মনোযোগ দেই। এক দুই দিন পার হওয়ার পর আর ঘুমের কোনো বালাই নেই। শুরু করলাম নতুন রুটিন। নামাজ-কোরআন তেলাওয়াতসহ ধর্মীয় চর্চার দিকে মনোযোগ দিয়েছি। কিছু সময় রাখতে হয় মনকে প্রফুল্ল করতে বিনোদনের জন্য। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা, বন্ধু, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি।
জাগো নিউজ : দেশের আদালত কবে খুলবে তা বলা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে অনলাইন অথবা ভিডিও কনফারেন্সে মামলার শুনানি করা কি সম্ভব?
ইকতান্দার বাপ্পী : দেখুন আমরা এ বিষয়ে অভ্যস্ত নই। সরকার দেশকে ডিজিটাল করার ঘোষণা দিয়ে থাকলেও আদালতকে ডিজিটাল করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। নিম্ন আদালতে বদলি মামলা খুঁজতে মাসের পর মাস লেগে যায়। বছরের পর বছর আইনজীবীরা এটা ডিজিটাল করার জন্য প্রস্তাব দিলেও অজানা কারণে এ বিষয়ে কাউকেই কথা বলতে দেখি না। বিচারকরা আন্তরিক হলেই সম্ভব। বিচারকরা যদি মনে করেন যে কনফারেন্সে মামলা শুনবেন সেটা করতে পারবেন।
তবে বিষয়টা এতটা সহজ নয়। যেহেতু আমাদের দেশে অনলাইনে সবাই অভিজ্ঞ নয়। কখনো কখনো বিচারকদের স্বাক্ষরও দরকার হবে জরুরি ভিত্তিতে। এমনিতেই আদালত এলাকায় জাল-জালিয়াতির ঘটনা আছে। আর সুপ্রিম কোর্টের মতো জেলা ও দায়রা আদালত সমূহের শুনানির কজ লিস্টও অনলাইনে দেয়া উচিত। এতে করে সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারবেন ওইদিন তার কোর্টে যাওয়া লাগবে কি-না। এছাড়া ভার্চুয়াল আদালত স্থাপনের জন্য বিচারক ও আইনজীবীদের অনলাইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ বিষয়ে বিচারকের সাথে সাথে আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। তাহলে আমাদের দেশেও উন্নত বিশ্বর মতো অনলাইনে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
জাগো নিউজ : করোনা পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী?
ইকতান্দার বাপ্পী : আমাদের গোটা দেশ একটা অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স হঠাৎ করে উল্লেখ্যযোগ্য হারেই কমে আসছে। প্রবাসীরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। আগামী ছয় মাস এর ধারাবাহিকতা থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। বৈশ্বিক মন্দায় পোশাক কারখানাগুলো টিকে থাকতে কষ্ট হবে। এক কোটির ওপরে আমাদের গার্মেন্টস কর্মী। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যে হারে ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে ২০ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে যেতে পারেন। এই মানুষগুলো অর্থনৈতিক সংকটে পড়বেন।
আমাদের উচিৎ নিজেদের ঐতিহ্যের পেশা কৃষি ও পশু পালনের দিকে মনোযোগ দেয়া। বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য আবাদ করা, হাস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন এখনই শুরু করা। এতে করে আর্থিক সমস্যার সাথে সাথে পরিবারের পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হবে। আর্থিক মন্দা বা সংকটের সময় সবারই আর্থিক ঘাটতি দেখা দিবে এটা স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কম করে হলেও দুই বছর লেগে যাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ১২ মাস ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ আমদানি করেছে যা সহজ ও সুলভ মূল্যে বিতরণ করছে। বাড়ির আশ-পাশে সব জায়গায় আবাদ করতে হবে। ডোবা-পুকুরে মাছ চাষ করতে হবে। এখন তো দেশে কৃষি বিপ্লব চলছে। অনেক শিক্ষিত ছেলে বিবিএ-এমবিএ করে চাকরি না করে বড় বড় গরুর ফার্ম করছে। মাছ চাষ করছে। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর হতে প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় বীজ ও কীটনাশক নিয়ে প্রত্যেকেরই উচিৎ কৃষির ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
সর্বোপরি যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা থাকতে হবে। রাষ্ট্রের উচিৎ ত্রাণের পাশাপাশি বিকল্প পথ দেখানো। খাস সম্পত্তিতে ফসল ফলানোর জন্য ভাগ করে দেয়া যেতে পারে। মহাসড়কের দুই পাশে স্থানীয়দের দিয়ে কৃষিকাজের ব্যবস্থা করা যায়। কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত বলে মনে করি। তাহলেই আমরা এই সংকটে দুর্ভিক্ষ নামক যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যেতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি।
জেএ/এইচএ/এমএস