ওষুধ টানছে না বিদেশি বিনিয়োগকারীদের

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, ০২ মার্চ ২০২১
দেশের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে ১২টিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে

>> ভালো ব্যবসা করতে পারছে না বেশিরভাগ কোম্পানি
>> কোনো রকমে টিকে আছে ছোট কোম্পানিগুলো

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানির সংখ্যা ৩১টি। এর মধ্যে ১৯টিতেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কোনো বিনিয়োগ নেই। বাকি ১২টি কোম্পানির মধ্যে তিনটিতে বিদেশিদের বড় বিনিয়োগ আছে। ৯টিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ থাকলেও তা অনেকটাই নামমাত্র। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলো যেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য টানতে পারছে না।

ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ কম থাকার কারণ হিসেবে বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ ও রসায়ন খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩১টি হলেও, সবার ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো না। বড় কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারলেও ছোটগুলো কোনো রকমে টিকে রয়েছে। এছাড়া অনেক কোম্পানির স্বচ্ছতার অভাব আছে। এসব কারণেই হয়তো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না কোম্পানি।

তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত চালাক। বিনিয়োগের আগে কোম্পানির অতীত-বর্তমান সব ধরনের তথ্য ভালো করে ক্ষতিয়ে দেখেন তারা। তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনার মূলে থাকে মুনাফার পরিকল্পনা। তাছাড়া বিদেশিদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও থাকে। সে কারণে যে কোম্পানির গ্রোথ (প্রবৃদ্ধি) ভালো এবং বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেদিকেই ছোটেন।

তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোতে বিদেশিদের বিনিয়োগের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, রেনেটা, একমি ল্যাবরেটরিজ, অ্যাকটিভ ফাইন, বেক্সিমকো সিনথেটিক, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, মেরিকো, ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, রেকিট বেনকিজার এবং সিলভা ফার্মায় বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে। ছয় মাস আগেও সিলকো ফার্মায় বিদেশিদের কিছু বিনিয়োগ থাকলেও এখন তা শূন্য হয়ে পড়েছে।

বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মায়। এই কোম্পানিতেও বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে এসেছে সম্প্রতি। ২০২০ সালের জুনে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩৪ দশমিক ৪৪ শতাংশই ছিল বিদেশিদের কাছে। গত ডিসেম্বরে তা কমে ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশে নেমে আসে। চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে তা আরও কমে ২৬ দশমিক ৪৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

১৯৮৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো ফার্মার লভ্যাংশের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে কোম্পানিটি। তার আগে ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ, ২০১৮ ও ২০১৭ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ এবং ২০১৬ সালে ১৫ শতাংশ নগদ ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। বর্তমানে কোম্পানিটিতে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ২৭৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

বিদেশিদের বিনিয়োগের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা রেনেটার ২২ দশমিক ৭৪ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। গত জুনে বিদেশিদের কাছে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ২২ দশমিক ৭৬ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে এই কোম্পানিটিতেও বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে।

১৯৭৯ সালে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারহোল্ডারদের ১৩০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগে ২০১৯ সালে ১০০ শতাংশ নগদ ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। এছাড়া ২০১৮ সালে ৯৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ সালে ১৩০ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৬ সালে ৮৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। বর্তমানে কোম্পানিটিতে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৮৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে তৃতীয় স্থানে। এ কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। গত বছরের জুনে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ ছিল বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে তা কমে ১৭ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।

ভালো ব্যবসার পাশাপাশি কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশও দেয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের ৪৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। তার আগে ২০১৯ সালে ৪২ শতাংশ নগদ ও ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৮ সালে ৩৬ শতাংশ নগদ ও ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০১৭ সালে ৩৫ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ৭ শতাংশ বেনাস শেয়ার এবং ২০১৬ সালে ৪০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি। বর্তমানে কোম্পানিটিতে রিজার্ভ আছে ৬ হাজার ৭০২ কোটি ১২ লাখ টাকা।

দেশের বাজারে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার রয়েছে পঞ্চম স্থানে। দেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে দামি শেয়ারের এই কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির সীমিতসংখ্যক শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরাই ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখেছে।

বিদেশিদের বিনিয়োগ থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে একমি ল্যাবরেটরিজের দশমিক ১৩ শতাংশ, অ্যাকটিভ ফাইনের ৩ দশমিক ১১ শতাংশ, বেক্সিমকো সিনথেটিকের দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, ইন্দো বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসের দশমিক ১০ শতাংশ, মেরিকো বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ওরিয়ন ইনফিউশনের দশমিক ৩০ শতাংশ, ওরিয়ন ফার্মার ১ দশমিক ১৩ শতাংশ, সিলভা ফার্মার দশমিক শূন্য ১ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে।

ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলো বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে না পারার কারণ হিসেবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানি অনেকগুলো হলেও সবাই ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। ভালো ব্যবসা করতে না পারলে বিদেশিরা কেন বিনিয়োগ করবে? আমি নিজেও তো এসব কোম্পানির শেয়ার কিনবো না। যারা ভালো ব্যবসা করছে তাদের শেয়ারে বিদেশিরা বিনিয়োগ করছেন।’

এ বিষয়ে রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেকিট বেনকিজার বহু আগে থেকেই বিনিয়োগ করছে। নতুন করে সেভাবে আসলে বিনিয়োগ আসছে না। আসলে বিদেশিরা কী কারণে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিতে বিনিয়োগ কম করছে, সে বিষয়ে মন্তব্য করা আমাদের জন্য ডিফিকাল্ট (কঠিন)।’

ইবনে সিনার সহকারী পরিচালক ও হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স আমিমুল ইহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ওষুধ খাত সুনাম অর্জন করেছে, কিন্তু এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেভাবে আকৃষ্ট হয়নি এটা সত্য। তবে সরকার এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট) ওষুধ শিল্প পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি এটা হলে ওষুধ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।’

সিলকো ফার্মার কোম্পানি সচিব টিংকু রঞ্জন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওষুধ ও রসায়ন খাতের ছোট কোম্পানির প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না— এমন কথা সরাসরি বলা যাবে না। আসলে বিদেশিরা বিনিয়োগের আগে কোম্পানি ভালো করে অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করে। কোম্পানি কেমন লভ্যাংশ দিচ্ছে, গ্রোথ কেমন, কোম্পানির ন্যাচার (বৈশিষ্ট্য) কেমন, মালিকপক্ষ কেমন— এসব বিষয় ক্ষতি দেখেই বিদেশিরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান আইসিবিও বিনিয়োগের আগে একটি কোম্পানি তিন বছর অবজার্ভ করে, তারপর বিনিয়োগ করে।’

জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ তারেক হুসাইন খান বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজারের ইমেজ ভালো নয়। কোম্পানির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে শেয়ারের বেচাকেনা ওঠা-নামা করে না। কিছু লোক আছে গুজব ছড়িয়ে তারা তাদের মতো মুনাফা তুলে নেয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো হচ্ছে না মন্দা হচ্ছে, সেসব বিষয় দেখে। তাছাড়া ব্যাংক লুট, পুঁজিবাজার লুটের নিউজ বাইরে যাচ্ছে। এসব কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন না।’

এমএএস/এমএসএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।