কঠিন দিনে পর্যটন
## পর্যটনশিল্পে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই এখন বেকার
## গত বছর ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা
## মেলেনি প্রণোদনা, ব্যাংক থেকে মিলছে না সহজশর্তে ঋণও
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে আছে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বন্ধ বছরপ্রতি দেড় থেকে দুই লাখ বিদেশি পর্যটকের বাংলাদেশ ভ্রমণ। ভিসা জটিলতা, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের কার্যক্রম স্বাভাবিক না হওয়ায় দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে পারছেন না দেশীয় পর্যটকরা। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন বড় অঙ্কের লোকসান গুনছেন পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা-ও বলতে পারছে না কেউ। এই অবস্থায় প্রণোদনাবঞ্চিত পর্যটনশিল্পের উদ্যোক্তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে পেশাই বদল করে ফেলছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতাধিক উপখাত নিয়ে গঠিত এ শিল্প ধুঁকছে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস থেকেই। করোনার প্রথম দিকে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকলেও পরে সবকিছু যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে তখন ধীরপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল পর্যটনশিল্প। তবে বৈশ্বিক করোনার পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় এবং চলতি বছরের মার্চের শেষ থেকে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আবারও খেই হারিয়েছে এ শিল্পের পদযাত্রা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ বিশাল। গত বছরের করোনার কারণে হোটেল-রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, এভিয়েশন, ট্যুর অপারেটরসহ পর্যটনের সঙ্গে জড়িতদের ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকার সেবা খাতের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ঝুঁকি বিবেচনায় পর্যটনশিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থায়ন করতে চাইছে না ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সরকারের সহায়তা চাইছেন পর্যটনশিল্পের উদ্যোক্তারা।
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিআরআইএবি) সভাপতি কবির উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কর্মীদের ছাঁটাই করতে হচ্ছে, কিংবা বেতন কম দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে কেউ বলতে পারছি না। সবমিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাদের। এ খাতের ২৫ লাখ কর্মী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কারও বেতন নেই, তো কারও চাকরি নেই।’
তিনি বলেন, ‘পর্যটন খাতে ঈদকেন্দ্রিক মূল ব্যবসাটা হয়। মানুষ লাইন দিয়ে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে যান। হোটেল-রিসোর্টে প্রোগ্রাম করেন। কিন্তু গত বছরের পর এবারও আমাদের সেই ব্যবসটা হচ্ছে না।’
অরুণিমা রিসোর্টের এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুধু হোটেল-রিসোর্ট খাতে ঈদকেন্দ্রিক পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। যেটা এবার হচ্ছে না। দীর্ঘদিন লোকসান টেনে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে বেশিরভাগই কর্মী ছাঁটাই করেছেন। শুধু নিরাপত্তাকর্মী দিয়েই এখন রিসোর্ট চালাচ্ছেন অনেকে। আমি আমার মেহগনি বাগান বিক্রি করে দিয়েছি গত বছর। সেটা দিয়ে রিসোর্টের ব্যয় মিটিয়েছি।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টেস অব বাংলাদেশের (অ্যাটাব) সাবেক প্রেসিডেন্ট এস এন মনজুর মোর্শেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এই ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম সেক্টর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকেই এক প্রকার বন্ধ। গত বছর মার্চে এখানে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও তার আগে থেকেই পর্যটনশিল্পে শনির দশা শুরু হয়েছে। অনেক দেশ আমাদের জন্য খোলেনি। ইউরোপের দুয়ার আমাদের জন্য বন্ধ আছে। থাই এয়ারওয়েজের বিমান দেড় বছর থেকে বন্ধ রেখেছে। এ রকম অনেক দেশ বন্ধ আছে। যেসব দেশে বাংলাদেশের পর্যটকরা যান সেগুলোর ভিজিট ভিসা বন্ধ আছে। ভারত, ভুটানের ভিজিট ভিসা বন্ধ। একমাত্র দুবাইয়ের ভিসা খোলা আছে, কিন্তু দুবাই ব্যয়বহুল হওয়ায় সেখানে তো সবাই যেতে পারেন না।’
‘এছাড়া আমাদের ইনবাউন্ড-আউটবাউন্ড ট্যুরিজম পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বিদেশও থেকে পর্যটকরা বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। প্রতিবছর ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোক বিদেশে যেতেন শুধু ঈদের সময়। আরও কয়েক লাখ লোক বিদেশ থেকে আসতেন। ব্যবসা নেই, পর্যটনের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ কর্মজীবী পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে আছেন। অনেক ছোট উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন’—বলেন মনজুর মোর্শেদ।
পর্যটনেশিল্পে ক্ষতির পরিমাণ কত
ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) বলছে, দেশের পর্যটনশিল্পে হোটেল, রিসোর্ট, ট্যুর অপারেটর, বিনোদনকেন্দ্র, এভিয়েশন, ক্রুজ শিপসহ প্রায় ১১৫টি উপখাত রয়েছে। গত বছর শুধু ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের মার্চ থেকে সবকিছু স্থবির হওয়ায় পর্যটন খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ছে। টোয়াব বলছে, জুন পর্যন্ত করোনার এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এভিয়েশন খাতে ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
টোয়াব সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ খাতে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। করোনাভাইরাসে এই খাতের মানুষগুলো কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’
টিআরআইএবি সভাপতি কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পর্যটনশিল্প তো অনেক বড় জায়গা। এখাতে ক্ষতির পরিমাণও বেশি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, গত বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। আর চলতি বছর এই লোকসান অব্যাহত আছে।’
টোয়াব সভাপতি বলেন, ‘করোনা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত। অনেককেই অফিস বন্ধ করে দিতে হয়েছে, কেউ কেউ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাই করে দিচ্ছেন। যে কোনো দুর্যোগে সবার আগে পর্যটন খাত বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয় সবার শেষে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই মানুষ বেড়ানোর চিন্তা করবে। এজন্য অন্যান্য শিল্পের তুলনায় আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।’
মিলছে না সরকারি কোনো সহায়তা
এদিকে করোনার বিরূপ প্রভাবে ট্যুর অপারেটর ও হোটেল-মোটেল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়লেও তারা যেমন প্রণোদনা পায়নি, তেমনি ব্যাংক থেকে সহজশর্তে ঋণও মিলছে না। পরিস্থিতি এমন যে সরকারি সহায়তা না পেলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা তো প্রণোদনা পাইনি। আবার সহজশর্তে ব্যাংক ঋণও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়েছি। ট্যাক্স, ভ্যাট কমাতে বলেছি। কী করবে দেখা যাক।’
আর এস এন মনজুর মোর্শেদ বলেন, ‘গত দুই বছরে সরকারের কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা করেনি সরকারের কেউ।’
পোশাকশিল্পের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘দেশে বড় একটি সেক্টরকে সব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে অনেক উপখাত জড়িত। এই শিল্পকে ঘিরে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। এ খাতে প্রায় ৩৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। এ মানুষগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ তাদের পাশে দাড়াঁনোর মতো কেউ নেই।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে ঝুঁকি খাত হিসেবে চিহ্নিত করে কোনো রকমের আর্থিক সহায়তা করতে চাইছে না। ব্যাংকগুলো আমাদের নিরুৎসাহিত করে। তারা আসলে ফান্ডিং করতে চায় না।’
পর্যটন খাতের এমন বিপদে সরকারের কাছে কোনো রকম সাহায্য পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত দুই বছরে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কেউ একটি ভার্চুয়াল বৈঠকও করতে পারেনি। সাহায্য তো দূরের কথা, কোনো আলোচনা আমাদের সঙ্গে করা হয়নি।’
কবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমাদের দাবিগুলো জানিয়েছি। মন্ত্রী মহোদয় আমাদের দাবিগুলো শুনেছেন, তারপরের খবর আর জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো রাস্তায় নামতে পারছি না। আমরা আন্দোলন করতেও পারছি না। কিন্তু আন্দোলন না করলে দেখছি কিছুই খুলে দিচ্ছে না। শিগগিরই আলোচনা করে আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করবো। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে রিসোর্টগুলো খোলা অন্ত্যন্ত জরুরি।’
এসএম/ইএ/এইচএ/এমএস