আলোর মুখ দেখছে প্রধানমন্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল আরকাম’

দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা। ২০১৮ সালে এ প্রকল্প শুরু হলেও ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর গত দেড় বছরেও আলোর মুখ দেখছে না বহুল কাঙ্ক্ষিত সারা দেশের এক হাজার ১০টি মাদরাসা।
ফলে প্রতিষ্ঠানের দুই হাজার ২০ জন শিক্ষকও দিশেহারা। তাদের বেতন-ভাতা নেই, নেই কোনো নির্দেশনা। তারা জানেও না, এই প্রকল্পের ভবিষ্যত কী? নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারছেন না।
প্রকল্পের তথ্য বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক অভিপ্রায় ও দিক-নির্দেশনায় প্রকৃত ইসলামি চেতনার মর্মালোকে আরবি ধারায় একটি দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে সারা দেশে একযোগে এক হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বালিয়া দারুল আরকাম মাদরাসায় দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়। ছবি সংগৃহীত
দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত এক মহতী উদ্যোগের ফসল। এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা, মর্মবাণী ও চেতনার প্রচার-প্রসার এবং আরবি ভাষা শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়। কোনো সরকারপ্রধানের উদ্যোগে একসঙ্গে এক হাজার ১০টি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার ঘটনাও ইতিহাসে বিরল।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্প’-এর আওতায় যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন পাঁচ হাজারের বেশি উচ্চশিক্ষিত আলেম-ওলামার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি লক্ষাধিক শিশু আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে দ্বীনি শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
একটি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসায় নতুন বই বিতরণ। ছবি-সংগৃহীত
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় পাঁচ হাজার আলেমের কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন দুই হাজার ২০ জন। যারা ২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন।
গত দেড় বছর ধরে তাদের বেতন-বোনাস কিছুই হচ্ছে না। সারা দেশের মাদরাসাগুলোও বন্ধ। শিক্ষকরা হতাশা নিয়ে মাঝে মাঝে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে গেলেও আশাব্যঞ্জক কোনো জবাব পাননি।
তবে আশার কথা জানিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে প্রকল্পের বিষয়ে সাড়া মিলেছে। তিনি আগামী ৫ বছরের জন্য এ প্রকল্পে ৫০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। আগামী আগস্ট থেকে প্রকল্পটি আগের মতো শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রতিমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বালিয়া দারুল আরকাম মাদরাসায় দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়। ছবি সংগৃহীত
প্রকল্পের শিক্ষক ও দারুল আরকাম শিক্ষক কল্যাণ সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমাদের প্রকল্প শেষ হয়। এরপর আর প্রকল্প পাস হয়নি। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। তবে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১৬ মার্চে করোনার ছুটির পর থেকে এখনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এরমধ্যে আমরা নানা সময়ে এমপি-মন্ত্রী ও অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেছি। শুধুমাত্র ধর্মপ্রতিমন্ত্রী বলেছেন- সময় লাগলেও আপনাদের প্রকল্পটা হবে। আর কেউই এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। বরং অনেকে এটাকে রাজনৈতিক প্রকল্প, আর হবে না কি-না! এ রকম নানা সন্দেহমূলক কথা বলছেন।’
জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক (পরিকল্পনা) হাজেরা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া ছিল দারুল আরকাম প্রকল্পটা হোক। আমরা প্রকল্প সব তৈরি করে সাবমিট করলাম, হয়ে গেলো। তখন পরিকল্পনা কমিশনের একটা মিটিংয়ে (প্রি-একনেক মিটিং) বলা হলো- আপনারা মাদরাসা বোর্ড ও সরকারের একটা মতামত নিয়ে আসেন। সরকারের মতামত তো আমাদের মন্ত্রণালয়ই দিতে পারে, দেবে।’
বেতন-ভাতা চালুর দাবিতে দারুল আরকাম শিক্ষকদের মানববন্ধন। ছবি- সংগৃহীত
তিনি বলেন, ‘মাদরাসা বোর্ডের কাছে গেলাম, তখন মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন- উনারা এ প্রকল্পের বিষয়ে জানেন না। মাদরাসা করতে হলে তাদের নিয়ম মেনেই করতে হবে। আমরা বলেছি- সে নিয়মে তো আমরা করব না। আমরা একটা প্রকল্প করব ৫ বছরের জন্য। ৫ বছর পরে দেখা যাবে কী হবে। তারা আমাদের সে ধরনের কিছু দেয়নি। যার কারণে আমরা প্রকল্পটা কন্টিনিউ (ধারাবাহিক) করতে পারিনি।’
হাজেরা খাতুন আরও বলেন, ‘শিক্ষকরা তো আসে আমাদের কাছে। তারা তো বেকায়দায়, দীর্ঘদিন বেতন নেই। তারাও চেষ্টা করছে। শিক্ষাবোর্ডে গেছেন, আমরাও গিয়েছি। শিক্ষাবোর্ড যদি বলে আপনারা করতে পারেন, তাহলেই হয়। এটা নিয়ে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। মানবিক বিষয় তো, শিক্ষকরা বেকায়দায় আছে।’
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রায় মাস দেড়েক আগে আমাদের মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর ও মাদরাসা বোর্ডের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মতামত চেয়েছে। আমরা মাসখানেক আগেই মতামত পাঠিয়ে দিয়েছি।’
বেতন-ভাতা চালুর দাবিতে দারুল আরকাম শিক্ষকদের সংবাদ সম্মেলন
তিনি বলেন, ‘যেহেতু এই প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন আছে, আমরা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করিনি। শুধুমাত্র একটা প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য কী কী নিয়ম প্রতিপালনের প্রয়োজন হয়, সেগুলো দেখিয়েছি। আমি যতটুকু জানি, ডিজি মহোদয়ও ঠিক নিয়মাবলি দেখিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মো. মুশফিকুর রহমান ও প্রকল্পের পরিচালক ফারুক আহম্মেদকে পাওয়া যায়নি।
দারুল আরকাম মাদরাসা পুনরায় চালুর দাবিতে স্মারকলিপি দেন শিক্ষকরা
জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ৫-৬ দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছিলাম। উনি অনুমোদন করেছেন। আগামী ৫ বছরের জন্য ৫০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর আমাদের কাছে চিঠি আসলো। আমরা আবার প্ল্যানিংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা যাচাই-বাছাই করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে অর্থ ছাড় হলেই আমরা কাজ শুরু করে দেব।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। তারা কোনো বেতন-ভাতা পায়নি। কারণ হলো- তাদের নিয়োগ বিধি-বিধান মোতাবেক হয়নি। পরে আমরা প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হই। উনি বিষয়টি ক্লিয়ার করে দিয়েছেন। আশা করছি- আগস্ট মাসের মধ্যে আমরা আবার শুরু করতে পারব।’
এসইউজে/এএএইচ/এসএইচএস/এএসএম