বিচার ‘চায় না’ ভিকটিমের পরিবার
সম্প্রতি বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের পর মামলা করতে ‘অনীহা’ প্রকাশ করেছে ভিকটিমের পরিবার। বিচার চান না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা। বিষয়টিকে ‘বিপজ্জনক’ ও ‘সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আইনের শাসনের দুর্বলতা’ বলছেন আইনজীবীরা। তাদের মতে, এটি দেশের জন্য ভালো খবর নয়। ধীরে ধীরে যদি এই মনোভাব সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সার্বিকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ সমস্যা সমাধানে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
তবে এ নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ বলছেন, যখন মানুষ দেখছে কোথাও গিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না, কারও কাছে বিচার দিয়ে লাভ হচ্ছে না- তখনই আমরা দেখলাম, মানুষ বলা শুরু করেছে, ‘কার কাছে বিচার দেবো’?
আবার অনেকেই বলছেন, কে বিচার চাইলেন বা চাইলেন না- সেটা বিষয় নয়। অপরাধ হলে রাষ্ট্র এটার বাদী হয় এবং বিচার হয়। হয়েও আসছে। এখন পর্যন্ত যত অপরাধ হয়েছে সবগুলোর বিচার হয়েছে, দৃষ্টান্তমূলক সাজাও হচ্ছে। সুতরাং দু-একজন বিচ্ছিন্নভাবে পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজির কথা বললেই সেই কথায় পুরো দেশের চিত্র ফুটে ওঠে না।
সম্প্রতি নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন দোকান কর্মচারী মুরসালিন। তার ভাই নূর মোহাম্মদকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন মামলা করবেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করে কী হবে? এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’
একইভাবে বিচার চান না নিহত নাহিদ হোসেনের মা নার্গিস। তিনি বলেন, ‘আমরা বিচার চাই না। নাহিদকে তো আর ফিরে পাবো না। বিচার চেয়ে কী হবে। চাইলেই তো আর বিচার পাবো না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?’ মামলা করবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা চালাতে টাকা-পয়সা লাগে। এগুলো করে লড়তে পারবো না। মামলা করে কী করবো। এগুলো করলে কি আমার ছেলে ফিরে আসবে? কতটা অত্যাচার করে আমার ছেলেকে মারা হলো! আমার যা যাওয়ার চলে গেছে।’
নিউমার্কেটের ঘটনার কিছুদিন আগেই রাজধানীর শাহজাহানপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি। মামলার বিষয়ে প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মামলা চালানোর মতো অবস্থা আমাদের নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। তাই কোনো বিচার চাই না। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই। তিনিই বিচার করবেন। কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না।’
এই বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি কেন তৈরি হচ্ছে? এর দায় কার? সমাধান কোন পথে? জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিটি ফৌজদারি অপরাধের বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে হবে। কেউ বিচার চান বা না চান। অপরাধ হলে রাষ্ট্র এটার বাদী হয় এবং বিচার হয়। দু-একজন বিচ্ছিন্নভাবে পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজির কথা বললেই সেই কথায় সব দেশের চিত্র ফুটে ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো যারা বলে তাদের হয়তো জ্ঞানের অভাব, হয়তো জানে না কোথায় যাবে, কী করবে! তবে দেশে বিচার হচ্ছে। আমরা আইন অঙ্গনে আছি, সারাক্ষণ বিচার কাজেই নিয়োজিত। প্রতিদিনই কোনো কোনো মামলার বিচারের রায় হচ্ছে। বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছে, বুয়েটের হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়েছে। কোনো অপরাধ বিচারহীন থাকবে না। সব অপরাধের বিচার হবে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি- প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের কাছে বিচার চাওয়ার একটা সংস্কৃতি। যখন মানুষ দেখলো সেখানেও আর কোনো কাজ হচ্ছে না। কারও কাছে বিচার দিয়ে লাভ হচ্ছে না। তখনই আমরা দেখলাম, মানুষ বলা শুরু করেছে- কার কাছে বিচার দেবো? কী লাভ? বিচার তো পাবো না। এই ঘটনা আমরা দীপন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রথম দেখলাম। তার বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যার বললেন, ‘একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার দিয়ে তো লাভ নেই। আমরা বিচার চাই না।’ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে খুঁজে বের করা হবে। ১২ বছরেও সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি মামলার চার্জশিট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে দেখলাম রুনির ভাই বলেছেন, ‘আমরা বিচার চাই না। রাষ্ট্রের কাছে বিচার চেয়ে আমরা লজ্জিত।’
তিনি বলেন, এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য সার্বিক ব্যর্থতা হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রের। এটা আমাদের সরকারের এবং বিচার বিভাগের ব্যর্থতা। প্রশাসন না পেরেছে তদন্ত নিশ্চিত করতে, না পেরেছে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগ না পেরেছে সুষ্ঠু বিচার করে নজির স্থাপন করতে। সুতরাং এটা আমাদের যৌথ ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার ফলে পুরো ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থা-ভরসা উঠে গেছে। মানুষ এখন আর বিচার চায় না। তারা মনে করে সময় নষ্ট। দিনের শেষে কোনো লাভ হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে বিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এটার অনুশীলন করেন আদালত। আদালতে বিচার পেলে পরে সেটা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এটা হলো প্র্যাকটিক্যাল আইনগত অবস্থান। কিন্তু আমরা কয়েক বছর ধরে দেখছি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনের শাসনের কিছু দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। এই দুর্বলতার ফসলটাই হলো ভিক্টিমদের বক্তব্য (বিচার না চাওয়া)।’
তিনি বলেন, ‘অপরাধ সংঘটিত হলে মামলার তদন্ত ও বিচারে কিছু হয় না। এ ধরনের একটা ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গেছে। সেটা বাস্তবও। মামলা হয়তো হয়, তদন্তও হয়। কিন্তু বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে শেষ করতে ২০-২৫ বছর লেগে যায়। অনেকক্ষেত্রে তো বিচার হয়-ই না। সাক্ষীসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়, নয়তো অন্য বিষয়। বিচার বিভাগেরও তো সক্ষমতা নেই, এত মামলা কীভাবে বিচার করবে? সবকিছু মিলিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তার চূড়ান্ত ফলাফল হলো- বিচার হচ্ছে না, এটাই মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।’
ফাস্ট ট্র্যাকে না উঠলে বিচার হয় না, এমন ধারণা তৈরি হয়েছে জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘কিছু কিছু বিচার হয় ফাস্ট ট্র্যাকে। কিছু ঘটনায় মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে বা সরকারপ্রধান অথবা সরকারের ইন্টারেস্ট (আগ্রহ) থাকে, সেগুলো দ্রুতই (বিচার) হয়ে যায়। কিন্তু অন্য বিচারগুলো হয় না। এই ফাস্ট ট্র্যাকে উঠতে না পারলে বিচার হবে না, এটাই মানুষের ধারণা। হত্যাকাণ্ড হলে থানা বা আদালতে দৌড়াতে হবে, সময় দিতে হবে, আল্টিমেটলি তো বিচার হবে না- এরকম একটা ধারণা থেকে অনেকেই বলেন, ‘আমি বিচার চাই না’।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ‘কিছু কিছু লোক আবার বিচার চান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন হলে তারা বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই’। এরকম একটা রং মেসেজ (ভুল বার্তা) মানুষের অন্তরে ঢুকে গেছে। তাদের ধারণা জন্মেছে যে, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, বিচারটাও মনে হয় তাদের হাতে! কিন্তু আইন তো সেটা বলে না। মানুষের মনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তা থেকে তারা বলেন- আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। এর উদাহরণও আছে।’
‘আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যকে যখন মেরে ফেলা হলো- এক দুদিনে কোনো খবর নাই। কেউ গ্রেফতার হয়নি, কিছুই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, মুখ খুলেছেন- তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রশাসনেও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে আইন অনুযায়ী চলার যে প্রাকটিস, সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে অনেক সময় প্রশাসনও তাকিয়ে থাকে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারা কী বলেন! তাদের কর্মকাণ্ড দেখে বা নির্দেশনা শুনে পদক্ষেপ নিতে আগ্রহ বোধ করে। ফলে স্বাধীনভাবে যে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেটা তারা করছে না। এ কারণেও মানুষের মনে ধারণা হয়েছে, বিচার চেয়ে লাভ হবে না। এজন্য তারা বিচার চায় না।’
এই ধারণাকে বিপজ্জনক উল্লেখ করে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এটা কিন্তু এখন কিছু লোকের ধারণা। এটা যদি ধীরে ধীরে সব মানুষের মধ্যে চলে যায় তাহলে সমাজে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে। মানুষ তখন মনে করবে, আইন-কানুন দরকার নাই। আমার যা করার আমিই করবো। প্রভাবশালীরা কিন্তু সেটাই করেন। যা খুশি করেন, আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেন না।’
এ অবস্থায় সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আইনের শাসনের যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে এটা দেশের জন্য ভালো খবর নয় বলে দাবি করেন এই আইনজীবী।
এই সমস্যা সমাধানে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবীর পরামর্শ, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিচার বিভাগ ও তদন্তের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে যদি রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করা হয়, সেটি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। পাশাপাশি বিচার বিভাগকেও শক্তিশালী করতে হবে। বিচার বিভাগে একটা মহাপরিকল্পনা নিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিচার দ্রুত করতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, তদন্তের পদ্ধতি তৈরি, লজিস্টিক সাপোর্ট তৈরিসহ নানা উদ্যোগ নিতে হবে। এটাও সরকারকেই করতে হবে। এগুলো করা গেলে হয়তো কিছুটা সমাধান আমরা খুঁজে পাবো।’
এসইউজে/কেএসআর/এএসএ/এমএস