বড়াইবাড়ী দিবস আজ


প্রকাশিত: ০৩:৩৪ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৬

আজ ১৮ এপ্রিল (সোমবার)। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী দিবস। ২০০১ সালের এই দিনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বড়াইবাড়ী গ্রামে ঢুকে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। অকুতোভয় বিডিআর ও গ্রামবাসীদের মিলিত প্রতিরোধে পর্যদস্তু হয় আগ্রাসনকারী বিএসএফ। নিহত হয় বাংলাদেশের তৎকালীন তিন বীর বিডিআর জোয়ান। ভারতীয় পক্ষে নিহত হয় ১৬ জন বিএসএফ সদস্য। সেই থেকে ঐতিহাসিক এই দিনটি পালিত হয় ‘বড়াইবাড়ী দিবস’ হিসেবে।

দিবসটি পালন উপলক্ষে রৌমারীতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য র্যালি, বড়াইবাড়ী গ্রামে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পম্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল। রৌমারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি রুহুল আমিন ও রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার বিশ্বাস, উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী, ওসি এবিএম সাজেদুল ইসলাম, বিজিবি রৌমারী কোম্পানি কমান্ডার, বড়াইবাড়ী ক্যাম্প কমান্ডার নায়েক সুবেদার শাহজাহান প্রমুখ।

জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভোরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ সীমান্তে অনধিকার প্রবেশ করে বড়াইবাড়ী গ্রামের ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলা চালায় ও বাড়ি-ঘর নির্বিচারে জ্বালিয়ে দেয়। ওই দিনের হামলার দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছিল বিডিআর-জনতা। আর সেই প্রতিরোধে বিএসএফ এর ১৬ জনের লাশ ফেলে পালিয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা। শহীদ হন ৩৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের ল্যান্স নায়েক ওহিদুজ্জামান, সিপাহী মাহফুজার রহমান এবং ২৬ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সিপাহী আ. কাদের। এছাড়া আহত হন বিডিআর এর হাবিলদার আব্দুল গনি, নায়েক নজরুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক আবু বকর সিদ্দিক, সিপাহী হাবিবুর রহমান ও জাহিদরু নবী।

বিএসএফ এর তাণ্ডবে পুড়ে ছাই হয়েছিল বড়াইবাড়ী গ্রামের ৮৯টি বাড়ি। সরকারি হিসেবে মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৭২ লাখ টাকা। এ ঘটনার ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও সীমান্তে শান্তি ফিরে আসেনি। কাটেনি সীমান্ত আতঙ্ক। গ্রামের মানুষ এখনও দুঃসহ স্মৃতিতে হঠাৎ রাতে আঁতকে উঠে। শেষ হয়নি তাদের দুঃখের দিন। পূরণ হয়নি সরকারি আশ্বাস। দেয়া হয়নি কড়া নিরাপত্তা, যোগাযোগ সুবিধাসহ নিরাপদ আবাসন হয়নি অনেকেরই। রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই, চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই, নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই পোড়া ভিটায় পোড়া টিনের চালের নিচে এবং ৮টি তাবুতেই কাটছে অনেকের দুর্বিসহ জীবন।

কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে রৌমারী উপজেলা শহর ৪৫ কি.মি. দূরে। তাও আবার ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন। রৌমারী উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ১০ কি.মি. দূরে বড়াইবাড়ী গ্রাম । ভারতের আসাম সীমান্তের ২২৬ একর জমি নিয়ে বড়াইবাড়ী গ্রাম যার আন্তর্জাতিক পিলার নম্বর ১০৬৭- ৪ এস। ঘটনার দিন ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বড়াইবাড়ী বিওপিতে ডিউটিতে ছিলেন মাত্র ১১ জন বিডিআর।

তারা হলেন- হাবিলদার নজরুল ইসলাম, নায়েক সুবেদার ডিএম আব্দুল্লাহ, ল্যান্স নায়েক ফজলুল হক, ল্যা. নায়েক ওয়াহিদ, সিপাহি মোজাম্মেল হোসেন, ইদ্রিস আলী, আ. হামিদ, লিটন মিয়া বদরুজ্জামান, ইসাহক, নায়েক এ এফ এম জালাল উদ্দিন এবং আদেশ দেন অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সায়রুজ্জামান  পিএসসি।  এর মধ্যে রাতে পালা করে চারজন ডিউটি দেন। ভোর পৌনে ৪ টায় আকস্মিকভাবে  গ্রামের তরুন মিনহাজ উদ্দিন বিওপিতে খবর দেয় কাঁটাতারের বেড়ার পূর্ব গেট দিয়ে বিএসএফ’র ৪ শতাধিক সদস্য ধান ক্ষেত দিয়ে ঢুকে পড়েছে এই গ্রামে। বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিষয়টি জানতে পেরে ৪টি মেশিনগান দিয়ে একযোগে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে।

আকস্মিক এ আক্রমণে বিচলিত হয়ে পালাতে শুরু করে বিএসএফ। এ সময় গোলাগুলিতে শাহাদৎ বরণ করেন বিডিআর এর ল্যান্স নায়েক ওহিদুজ্জামান এবং ভারতীয় পক্ষের ১৬ জন বিএসএফ নিহত হয় এবং দু’জন যুদ্ধবন্দিকে আটক করে বিজিবি। এরপর টানা দু’দিন চলে সংঘর্ষ। বিজিবি’র পক্ষে জীবন বাজি রেখে যোগ দেয় স্থানীয় গ্রামবাসীরা। টানা সংঘর্ষে নিহত হয় বিজিবির সদস্য ৪১৫২৪১ মাহফুজার রহমান ও আ. কাদের।

এ সময় বিএসএফয়ের গুলিতে আহত গ্রামবাসীরা হলেন- মোস্তফা মুন্সি (৪০), সাইফুন (৩২), মোখলেজা (৮) নার্গিস (১৮), তমিরন বেওয়া (৪৮), শেখ সাদী (৪), বিলকিস খাতুন (১২), মকবুল হোসেন (৬০), ছমিরন নেছা (৫৫)।
 
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, বড়াইবাড়ী গ্রামে যাওয়ার রাস্তাগুলো খানাখন্দে ভরা। গাড়ী তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটে যাওয়া দায়। তার উপর কাশিয়াবাড়ী ও মাদার টিলা ব্রিজ দুটি ভেঙে গেলেও তা সংস্কার করে নির্মাণ হয়নি। এছাড়া ধরনী নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ না হওয়ায় বড়াইবাড়ী গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা নাজুক যে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো অবরুদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে। জিঞ্জিরাম, পাটাধোয়া ও কালো নদী এবং এর দুটি শাখা নদীতে ৫টি বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয় সীমান্তবর্তী বড়াইবাড়ী গ্রামে। আগে এ গ্রামে ৩৫০টি পরিবার বসবাস করত। সংঘর্ষের পর কিছু পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে ২১৮টি পরিবার ওই গ্রামে বসবাস করছে। কিন্তু তাদের প্রতিটি মুহূর্ত এখনো কাটে আতঙ্ক উৎকণ্ঠার মধ্যে। সরকার, রেড ক্রিসেন্ট ও এনজিও’র দেয়া সহায়তা নিয়ে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে এসব পরিবার। এখনও ৮ টি পরিবার তাবুতে বসবাস করছে।

গ্রামের ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আ. ছালাম, দিনমজুর রইচ উদ্দিন (৬৫), প্রাক্তন মেম্বার আ. কাদের (৫০), মজিবর রহমান (৪৭) জানান তাদের দুর্বিসহ জীবনের কথা। আগে গ্রামে সুখ ছিল, শান্তি ছিল, সুখে-দুঃখে দু’পাড়ের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বিএসএফ তাদের সহযোগিতা করতো। যুদ্ধের পর সব যেন তাসের ঘরের মত ভেঙে গেছে। এখন সীমান্ত ঘেঁষা জমিগুলোতে আবাদ করতে যেতে হয় জীবন বাজি রেখে। আর ক’দিন পর ধান পাকবে। কৃষকদের মনে ভয় ধান কাটতে পারবো তো? তাদের দাবি সরকারি আশ্বাসের বাস্তবায়ন ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করন এবং বড়াইবাড়ী দিবসটিকে যেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এসএস/এমএস

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।