মিরপুরে টিকিট কালোবাজারি, প্রতারণার শিকার দর্শকরা

ইমাম হোসাইন সোহেল
ইমাম হোসাইন সোহেল ইমাম হোসাইন সোহেল
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ পিএম, ২০ জুলাই ২০২৫

শাহ আলম, হাবিবুর রহমান ও আবদুস সবুর নামে তিন মাদরাসাপড়ুয়া আশুলিয়া থেকে মিরপুর এসেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ দেখার জন্য। তিনজনই পড়ে দশম শ্রেণিতে। টিকিটের কোনো ব্যবস্থা করে আসেনি। আশা, মিরপুর স্টেডিয়ামের আশপাশে এসে হয় বুথ থেকে, না হয় কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কিনবে। সে মতো, স্টেডিয়ামের আশপাশে এসে বুথে টিকিট খুঁজতে গিয়ে পেল না। কারণ, এবার বিসিবি পাকিস্তান সিরিজের সব টিকিট ছেড়েছে অনলাইনে।

বুথে না পেয়ে এই তিন শিক্ষার্থী টিকিট খুঁজতে শুরু করে কালোবাজারে। স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় এক কালোবাজারিকে পেয়েও গেল তারা। ৩০০ টাকার তিনটা গ্যালারির টিকিট কিনল ৩৫০ টাকা করে। টিকিট নিয়ে খুশি মনে এই তিন শিক্ষার্থী গেটে চলে এলো গ্যালারিতে প্রবেশ করার জন্য।

কিন্তু এখানে এসেই তারা বুঝতে পারে, প্রতারণার শিকার হয়েছে তারা। যে তিনটি টিকিট নিয়ে এসেছিল, প্রবেশ পথে বসানো স্ক্যানারে দেখা গেলো-অলরেডি ইউজড। অর্থাৎ ইতোমধ্যেই এই তিনটি টিকিটধারী ব্যক্তি গ্যালারিতে প্রবেশ করেছে। মাদরাসার ওই তিন শিক্ষার্থী টিকিট কিনেও মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার একপাশে। এরপর তারা ঘুরছিল, কীভাবে ওই টিকিট দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। পরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে, তারা প্রতারণার শিকার হয়েছে।

একই সময় ভিড় থেকে মনসুর নামে মিরপুরের স্থানীয় এক যুবক জানান, এক কালোবাজারি তার কাছে ভিআইপি-৩ এর টিকিট ৪ হাজার টাকা এবং ভিআইপি-১ এর টিকিট ১ হাজার টাকা চেয়েছে (মূলত ভিআইপি-১ ও ভিআইপি-৩ নামে কোনো গ্যালারিই নেই মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে)। তিনি প্রতারণা বুঝতে পেরে আর টিকিট নিয়ে দামাদামি করেননি।

মাসুদ পারভেজ নামে মিরপুরের আরেক তরুণ, যিনি পড়ালেখা শেষ করে আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার সামনেই এক লোক একটি টিকিটকে চারটি ফটোকপি করেছে। এরপর এসে বিক্রির চেষ্টা করেন।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা ইয়ামিন ও সাগর নামে দুই কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে দেখিয়ে মাসুদ পারভেজ বলেন, কালোবাজারি তাদের কাছে ওই ফটোকপি বিক্রির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি বিষয়টা ধরতে পারায় ওই দুই শিক্ষার্থী প্রতারণা থেকে রেহাই পান।

বিসিবি এবার বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজের জন্য টিকিট ছেড়েছে অনলাইনে। www.gobcbticket.com.bd নামে একটি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে এই সিরিজের টিকিট। কিন্তু অনেক দর্শক বিষয়টা জানেন না। তারা খেলা দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে চলে এসেছেন মিরপুরে। কিন্তু এসে দেখেন এখানে সরাসরি টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। অনেকেই আশা করেন, স্টেডিয়ামের পাশে কালোবাজারে টিকিট পাবেন। সে হিসেবে তারা টিকিট খোঁজা শুরু করেছিলেন। এরই সুযোগ নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। তারা অনলাইনে কাটা একটি টিকিটের বেশ কিছু কপি করে কালোবাজারে বিক্রির চেষ্টা করছে। অনেকেই তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন; কিন্তু মাঠে প্রবেশ করতে পারেননি।

jagonews

ঢাকার পূর্বাচল-কাঞ্চন এলাকা থেকে খেলা দেখতে এসেছেন ইয়াসিন ও হামিদুল্লাহ নামে দুজন। বাংলাদেশের জার্সি পরে এসেছেন খুব উৎসাহ নিয়ে। তাদের আশা, যেভাবে হোক মাঠে প্রবেশ করবেন। কিন্তু নিজেরা না পারছেন অনলাইনে টিকিট কাটতে, না পাচ্ছেন বুথে টিকিট কিনতে। খুঁজছিলেন, কালোবাজারে টিকিট পাওয়া যায় কি না; কিন্তু কয়েকজনের প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা শুনে তারা চুপসে যান। টিকিট কিনতে না পেরে হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে দেখা যায় তাদের।

নরসিংদী থেকে খেলা দেখতে এসেছিলেন তরিকুল নামে এক তরুণ। দুদিন ধরে অনলাইনে টিকিট কাটার চেষ্টা করেন। পারেননি। ফেসবুকে প্রচারণা দেখেছেন, টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। সরল বিশ্বাসে ফেসবুকে দেওয়া নাম্বারে যোগাযোগ করে অগ্রিম ৩০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন টিকিটের জন্য। এরপর নাকি যে নাম্বারে টাকা পাঠিয়েছিলেন, সেই নাম্বারই বন্ধ পেতে থাকেন। ম্যাচ শুরুর আগেও তাকে দেখা যায় সেই নাম্বারে যোগাযোগ করতে। কিন্তু তখনও সেই নাম্বারটি বন্ধ দেখা যাচ্ছিল।

তরিকুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাই এখন আর টাকা দিয়েও অনলাইনে টিকিট কেটে খেলা দেখতে পারবো না। কারণ, আমার কাছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ভাড়া ছাড়া কোনো টাকাই নেই। বাংলাদেশের খেলা দেখার অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। এখান খেলা না দেখেই ফিরে যেতে হচ্ছে।’

একইভাবে মৌলভীবাজার থেকে খেলা দেখতে এসেছেন ক্রিকেটপাগল হারুনুর রশিদ, গাজীপুরের মাওনা থেকে হাফিজুর রহমান ও জয়নাল আবদিন। সবারই একই গল্প। কালোবাজারে টিকিট কেনার আশা ছিল তাদের; কিন্তু মিরপুরে এসে দেখেন কিছু মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিজেরাও অনলাইনে টিকিট কাটতে পারছেন না। ফলে হতাশা নিয়েই তাদের ফিরে যেতে হলো।

এবার অনলাইনে টিকিট ছাড়ার কারণে, বুথে বা ম্যানুয়ালি টিকিট বিক্রি ছিল বন্ধ। তবে, যারা অনলাইনে টিকিট কিনেছেন, তাদেরও বিভ্রান্তিতে দেখা গেছে। শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ১ নম্বর গেটের উল্টো পাশে একটি প্রিন্ট ও ফটোস্ট্যাটের দোকানে দেখা গেলো প্রচুর ভিড়। অনলাইন থেকে ডাইনলোড করা টিকিট প্রিন্ট করছেন তারা। সিরিয়াল ধরে চলছে সেই প্রিন্টের কাজ। প্রতি কপি ১০ টাকা করে। আবার গ্রুপে গ্রুপে দেখা গেলো অনলাইনে টিকিট কেনার চেষ্টা করছেন অনেকে। যিনি একটু এক্সপার্ট, তাকে ঘিরে ধরছেন আট-দশজন। সবারই একটি কথা, ‘ভাই আমারটা একটু দেখেন, ভাই আমারটা একটু দেখেন।’

মোটকথা, অনলাইনে টিকিট বিক্রির ফলে সাধারণ দর্শকদের ঝামেলা কমলেও না জানার ফলে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। অনেকেই কালোবাজারে টিকিট কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আবার প্রবেশ পথে টিকিট চেকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, অনলাইন কপি প্রিন্টেরও প্রয়োজন নেই। মোবাইলে দেখালেই চলবে। প্রয়োজনে সেখানে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেও চলবে। কিন্তু কেউ কেউ না জানার ফলে প্রিন্টের দোকানে গিয়ে ভিড় করতে শুরু করে, ডাউনলোড কপি প্রিন্ট দেওয়ার জন্য।

আইএইচএস/এমএমআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।